Thank you for trying Sticky AMP!!

সম্প্রীতি ও শান্তির বার্তা নিয়ে আজ আসছেন পোপ

পোপ ফ্রান্সিস

রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সংকটের প্রেক্ষাপটে সম্প্রীতি ও শান্তির বার্তা নিয়ে তিন দিনের সফরে আজ বাংলাদেশে আসছেন পোপ ফ্রান্সিস। পোপ তাঁর মিয়ানমার সফরকালে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ উচ্চারণ করেননি। এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গুরুত্ব পেয়েছে। এখন আশা করা হচ্ছে, পোপ তাঁর বাংলাদেশ সফরে রোহিঙ্গা শব্দ উচ্চারণ করবেন। কাল শুক্রবার রমনা উদ্যানে অনুষ্ঠেয় আন্তধর্মীয় ও আন্তমান্ডলিক সমাবেশে ১৬ জন রোহিঙ্গার একটি প্রতিনিধিদল উপস্থিত থাকবে।

পোপের সংবর্ধনায় গঠিত মিডিয়া কমিটির সমন্বয়ক ফাদার কমল কেরাইয়া গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ানমারের বিশপ সম্মিলনী যেভাবে রোহিঙ্গা শব্দ ব্যবহারে আপত্তি তুলেছে, সে রকম আপত্তি বাংলাদেশের বিশপ সম্মিলনীর নেই। বরং পোপ এর আগে রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তবে ঢাকায় তিনি রোহিঙ্গা শব্দ বলবেন কি না, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়।

উল্লেখ্য, পোপ দুই পরিচয়ে এই সফর করবেন। প্রথমত মাত্র ৩১৯ একর আয়তনের ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র ভ্যাটিকানের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে, জাতির জনকের জাদুঘরে ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। প্রধানমন্ত্রীও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। তবে পোপ অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন না।

দ্বিতীয়ত, রোমান ক্যাথলিক গির্জার মহামহিম ও সর্বজনীন যাজক হিসেবেও তিনি এই সফরে আসছেন। ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় পোপ জন পলের সফরকালে আর্মি স্টেডিয়ামে প্রায় ৫০ হাজার ক্যাথলিক খ্রিষ্টানের সমাগম ঘটেছিল, এবারে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে ৮০ হাজার ক্যাথলিকের উপস্থিতির পরিকল্পনা করা হয়েছে। খ্রিষ্টান সম্প্রদায়সহ সব মানুষের কাছে তাঁর এই আগমন জনগণের আত্মার প্রতি একধরনের তীর্থযাত্রা বলেও গণ্য হবে। একজন আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে তিনি আসবেন। দেশের খ্রিষ্টান ধর্মগুরু, যুবক ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশে তিনি বক্তব্য দেবেন।

খ্রিষ্টানদের ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের প্রধান কোনো ধর্মগুরুর বাংলাদেশে এটি তৃতীয় সফর। ১৯৭০ সালে পোপ ষষ্ঠ পল প্রথম বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল বাংলাদেশ সফরে এসে প্লেন থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশের মাটি চুম্বন করেছিলেন। আর তিনি উক্তি করেছিলেন, ‘আমি বাংলাদেশের জনগণের আত্মার কাছে একজন তীর্থযাত্রী হিসেবে এসেছি।’

মিয়ানমারে তিন দিনের সফর শেষ করে ইয়াঙ্গুন থেকে সরাসরি বৃহস্পতিবার বেলা তিনটায় ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন। প্রথা অনুযায়ী তিনি বাংলাদেশে অবস্থিত ভ্যাটিকান দূতাবাসে অবস্থান করবেন। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের উদ্দেশে যাত্রার প্রাক্কালে ২৫ নভেম্বর এক টুইটার বার্তায় পোপ বলেছেন, ‘যেহেতু আমি মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছি, আমি সকলকে শুভেচ্ছা ও বন্ধুত্বের বার্তা পৌঁছে দিতে চাই। তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে আমি অধীর আগ্রহী।’ এর আগে এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘আমি আসছি যিশুখ্রিষ্টের মঙ্গল সমাচারের সেবক হিসেবে; এই মঙ্গল সমাচারের পুনর্মিলন, ক্ষমা এবং শান্তির বার্তা ঘোষণা করতে।’

পোপ ফ্রান্সিসের পারিবারিক নাম জর্জ মারিও বেরগোগ্লিও। ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ ২৬৬তম পোপ হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। আসিসির সাধু ফ্রান্সিসের আদর্শ স্মরণে পোপ হিসেবে তিনি প্রথম ফ্রান্সিস নামটি ধারণ করেন। আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসের ফ্লরেস শহরে ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। তাঁর বাবা হোসো মারিও বেরগোগ্লিও ছিলেন রেলওয়ের একজন হিসাবরক্ষক এবং মা রেজিনা মারিয়া সিভোরি ছিলেন একজন গৃহিণী। ১৯৬৯ সালে ৩৩ বছর বয়সে যাজক হিসেবে অভিষিক্ত হন তিনি। ১৯৯৮ সালে হন আর্চবিশপ। এর তিন বছরের মাথায় পোপ দ্বিতীয় জন পল তাঁকে আর্জেন্টিনার কার্ডিনাল হিসেবে নিযুক্ত করেন।

এই ধর্মগুরু দর্শনশাস্ত্র ও ঐশতত্ত্ব নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন। ঐশতত্ত্বে তাঁর উচ্চতর ডিগ্রিও রয়েছে। ১৯৬৪ থেকে ৬৬ সাল পর্যন্ত কলেজিও দা ল্যা ইম্মাকুলাডা কনসেন্সিয়ন স্কুল এবং কলেজিও ডেল সালভাদর কলেজে মনোবিজ্ঞান ও সাহিত্য বিষয়ে শিক্ষকতা করেন।

কর্মসূচি

আজ বিকেল চারটায় জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে পোপ বাংলাদেশে তাঁর কর্মসূচি শুরু করবেন। এরপর পৌনে পাঁচটায় বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও স্মৃতিগ্রন্থে স্বাক্ষর করবেন। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় তিনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করবেন। ছয়টায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, সুশীল সমাজ ও কূটনৈতিক মহলের সঙ্গে সভা করবেন এবং বক্তব্য দেবেন।

দ্বিতীয় দিনে সকাল ১০টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খ্রিষ্টধর্মীয় উপাসনা ও যাজক অভিষেক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেবেন পোপ। ৩টা ২০ মিনিটে ভ্যাটিকান দূতাবাসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন। চারটায় ক্যাথিড্রাল পরিদর্শনের পর সোয়া ৪টায় রমনায় প্রবীণ যাজক ভবনে বাংলাদেশের বিশপদের সঙ্গে বিশেষ মিটিং সভা করবেন। সেখানে বক্তব্য দেওয়া শেষে বিকেল ৫টায় আর্চবিশপ হাউসের মাঠে আন্তধর্মীয় ও আন্তমান্ডলিক সমাবেশ বক্তব্য দেবেন তিনি।

তৃতীয় দিন শনিবার সকাল ১০টায় তেজগাঁওয়ে মাদার তেরেসা ভবন পরিদর্শন করবেন পোপ। পৌনে ১১টায় যাজক বর্গ, সন্ন্যাসব্রতী, উৎসর্গীকৃত নর-নারী, সেমিনারিয়ান ও নবিশদের সমাবেশে বক্তব্য দেবেন তিনি। দুপুর পৌনে ১২টায় তেজগাঁও কবরস্থান ও পুরাতন গির্জা পরিদর্শন করবেন। ৩টা ২০ মিনিটে নটর ডেম কলেজে যুব সমাবেশে বক্তব্য দেবেন। পৌনে ৫টায় তাঁকে বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানানো হবে এবং ৫টা ৫ মিনিটে রোমের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বেন তিনি।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী

পোপ ফ্রান্সিসের বাংলাদেশে আগমনকে স্বাগত জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তাঁর বাণীতে বলেছেন, পোপ ফ্রান্সিসের বাংলাদেশ সফরের ফলে কেবল খ্রিষ্টান সম্প্রদায় নয়, বরং সব ধর্মের মানুষের মধ্যে সাম্য, ঐক্য, সম্প্রীতি ও শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে বলেছেন, ‘১৯৭১ সালে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বহু মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধ চলাকালে বহু অসহায় এবং গৃহহারা মানুষ তাঁদের গির্জা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে এই সম্প্রদায়ের নাগরিকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ মাতৃভূমির প্রতি তাঁদের অপরিসীম ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ।’

উল্লেখ্য, ষষ্ঠ পোপ একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে তাঁর নানসিও, অর্থাৎ বিশেষ দূতকে পাঠিয়েছিলেন। ওই দূত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। আবার যুদ্ধ শেষে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ধারণে দুজনের একটি টিমকে পাঠিয়েছিলেন। তিয়াত্তরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ভ্যাটিকানের দূতাবাস খোলা হয়।

মিয়ানমারে উন্মুক্ত গণপ্রার্থনা

রয়টার্স জানায়, মিয়ানমারে শান্তি ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করতে দেশটির জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্ব ক্যাথলিক খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রধান গুরু পোপ ফ্রান্সিস। গতকাল বুধবার ইয়াঙ্গুনে এক উন্মুক্ত গণপ্রার্থনায় এই আহ্বান জানান তিনি। প্রায় পাঁচ দশকের সামরিক শাসনের অবসান শেষে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের যাত্রা এবং দেশটিতে জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত চলার প্রেক্ষাপটে পোপ দেশটির অধিবাসীদের প্রতি এই আহ্বান জানালেন।

মিয়ানমারে বসবাসকারী প্রায় ৭ লাখ রোমান ক্যাথলিকের অনেকে গতকাল পোপের এ গণপ্রার্থনায় যোগ দেন। প্রার্থনায় সমবেত হওয়া লাখো মানুষের মধ্যে ছিলেন খ্রিষ্টান পুরোহিত, নান, কূটনীতিক, অং সান সু চির ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) উচ্চপর্যায়ের নেতা ও বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর সদস্য।

পোপ ফ্রান্সিস বলেন, ‘আমি জানি, মিয়ানমারের অনেকে সহিংসতার দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন। আমি অনুরোধ জানাই, তাঁরা যেন ক্ষোভ ও প্রতিশোধ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে প্রলোভনে পা দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।’

এদিকে, বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, গতকাল পোপ মিয়ানমারের বৌদ্ধধর্মীয় নেতাদের প্রতি ‘ঘৃণা ও বিদ্বেষ’ জয় করার আহ্বান জানিয়েছেন। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চলায় দেশটির বৌদ্ধধর্মীয় নেতারা আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রয়েছেন।

মিয়ানমার সফরে পোপ ফ্রান্সিস জনসমক্ষে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ ব্যবহার না করার বিষয়ে একটি যুক্তি দিয়েছে ভ্যাটিকান। ভ্যাটিকানের মুখপাত্র গ্রেগ বুরক গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, পোপের নৈতিক অবস্থান নিষ্কলুষ, সেটা তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেন না। কাজেই তিনি প্রকাশ্য বক্তব্যে বিতর্কিত বিষয় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন।