Thank you for trying Sticky AMP!!

সাইবার বুলিং নিয়ে হোক প্রতিবাদ

চলতি বছরের মে মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকের প্রোফাইল পিকচার বদলে যেতে থাকে। সেখানে জায়গা করে নেয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী ও তাঁর মায়ের ছবি। এর আগেই মা দিবসে চঞ্চল চৌধুরীর পোস্ট করা তাঁর মায়ের ছবির নিচে একেকজন সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করতে থাকেন। এতে চঞ্চল চৌধুরী ক্ষুব্ধ হন। তারপর প্রতিবাদ হিসেবে প্রোফাইল পিকচার বদলিয়ে হ্যাশট্যাগে লেখেন ‘চঞ্চল চৌধুরী ইজ আওয়ার ব্রাদার’, ‘তোমার মা আমার মা’, ‘আমার মা, তোমার মা’, ‘স্টপ সাইবার বুলিং’, ‘হোক প্রতিবাদ’।

সে সময় আক্রমণের শিকার হন বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের সাবেক ক্রিকেটার, উপস্থাপক ও অভিনয়শিল্পী মিশু চৌধুরী। সম্প্রতি শুরু হয়েছে নায়িকা পরীমনিকে নিয়ে। তিনি ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ করেছেন। তবে পরীমনির বিভিন্ন পোস্টে পোস্টদাতাদের বেশির ভাগেরই মন্তব্য, কেন তিনি প্রোফাইল পিকচারে এমন ছবি দিয়েছেন। কেন এ ছবি পাল্টাচ্ছেন না।

২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে নিজের নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ৪০টির বেশি ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন তখনকার ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে অপপ্রচারের আশঙ্কা ও সাইবার নিরাপত্তাহীনতায় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন।

বিনোদনজগতের বাসিন্দা, সমাজে কিছুটা হলেও প্রভাব আছে এমন ব্যক্তিদের পাশাপাশি কত মানুষ সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে নারী ও শিশু-কিশোরেরা এতে বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে বিভিন্ন জরিপ বলছে। ইন্টারনেটে ব্যক্তিগত ছবি–ভিডিও ছড়িয়ে, ফেসবুক আইডি হ্যাক করে হুমকি দিয়ে অর্থ আদায়, ছবি বা ভিডিও এডিট করে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি, সুপার ইম্পোজ ছবি, পর্নোগ্রাফি, ছবি দিয়ে আপত্তিকর কনটেন্ট বা ফেক আইডি তৈরি, ফোন নম্বর ছড়িয়ে দেওয়া, হয়রানিমূলক এসএমএস, মেইল বা লিংক পাঠানোসহ বিভিন্ন উপায়ে এ হয়রানি করা হচ্ছে।

গত বছরের মে মাসে সুইজারল্যান্ডসের জেনেভাভিত্তিক জাতিসংঘের সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস ইউনিয়ন (আইটিইউ) বলেছে, করোনায় শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়ায় সাইবার বুলিং বা হয়রানির ঝুঁকি অনেক গুণ বেড়েছে।

পরিসংখ্যানের বাড়াবাড়ি
আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার ‘হাইওয়ে’ হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ইন্টারনেট বা সাইবার স্পেস। দেশে প্রতি ১২ সেকেন্ডে ফেসবুকে একজন নতুন ব্যবহারকারী যুক্ত হচ্ছেন, যা দেশের জন্মহারের চেয়েও বেশি। অন্যদিকে, বাস্তব জীবনে ঘটমান অপরাধগুলো এখন ডিজিটাল মাধ্যমে স্থানান্তরিত হচ্ছে। ফলে, হয়রানির শিকার হওয়াসংক্রান্ত পরিসংখ্যানগুলো বেশ অস্বস্তিজনক।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক লেখায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম) মাহ্‌ফুজা লিজা উল্লেখ করেছেন, গত পাঁচ বছরে সাইবার ক্রাইম বিষয়ে যত মামলা হয়েছে, তা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভিকটিমদের শতকরা ৬৫ ভাগই নারী।

গত বছরের ১৬ নভেম্বর পুলিশ সদর দপ্তরে ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ নামে একটি অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ চালু হয়েছে। নতুন এ সেবার উদ্বোধনের সময় পুলিশের আইজিপি বেনজীর আহমেদ জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, পর্নোগ্রাফি কন্ট্রোল অ্যাক্ট, আইসিটি অ্যাক্ট, টেলিকমিউনিকেশন অ্যাক্ট—এসব আইনে এ পর্যন্ত মোট ৬ হাজার ৯৯টি মামলা হয়েছে, এর অধিকাংশ ঘটনার ভিকটিম বা শিকার নারী (১৮ থেকে ২৪ বছর বয়স)।

অনলাইনে হয়রানি ও সহিংসতার মাত্রা বুঝতে প্রথম আলো ও বেসরকারি সংগঠন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ গত বছর ২১ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপ বলছে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৭৯ শতাংশের বেশি কখনো না কখনো অনলাইনে হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন।

এর মধ্যে নারী প্রায় ৫৩ শতাংশ।
সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের ‘সাইবার বুলিং অ্যাগেইনস্ট গার্লস অ্যান্ড উইমেন ওভার সোশ্যাল মিডিয়া’ শীর্ষক জরিপ বলছে, যৌন হয়রানিমূলক ভিডিও, বার্তা ও ছবির মাধ্যমে গ্রামে ৩৩ শতাংশ এবং শহরের ৬৪ শতাংশ মেয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছে।
গত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে লন্ডনভিত্তিক ইকোনমিস্ট গ্রুপের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) প্রকাশিত ৫১টি দেশের ওপর বৈশ্বিক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অংশগ্রহণকারী নারীদের ৮৫ শতাংশ অনলাইনে সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এ সহিংসতায় বিশ্বে এশিয়ার অবস্থান চতুর্থ। ওই জরিপে বাংলাদেশের ১০০ নারীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইন্টারনেট নারীর জন্য শাঁখের করাত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০১৯ সালের শুরুতে জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফ বাংলাদেশের ‘বাংলাদেশের শিশুদের অনলাইন নিরাপত্তা’ শীর্ষক জরিপ বলছে, দেশের ৩২ শতাংশ শিশু অনলাইনে সহিংসতা, ভয়ভীতি ও উৎপীড়নের শিকার হয়েছে। জরিপ বলছে, ৭০ শতাংশ ছেলে ও ৪৪ শতাংশ মেয়ে অনলাইনে অপরিচিত মানুষের বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করে। ১৪ শতাংশ ইন্টারনেটে পরিচয় হওয়া ‘বন্ধুদের’ সঙ্গে সরাসরি দেখা করেছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৯ শতাংশ শিশু ধর্মীয় উসকানিমূলক বিষয়বস্তুর মুখোমুখি হওয়ার কথা জানিয়েছিল। ইউনিসেফ বাংলাদেশসহ ১৬০টি দেশে এ জরিপ চালিয়েছিল।

প্রতিকারের জায়গাও আছে
ইন্টারনেটের এই সময়ে এসে সাইবার অপরাধকে জটিল এক মনস্তাত্ত্বিক উপদ্রব হিসেবে দেখছেন সাইবার অপরাধ নিয়ে কর্মরত ব্যক্তিরা। তাঁদের পরামর্শ হলো প্রথমেই নিজেকে বোঝাতে হবে, এটি আপনার দোষ নয়। আর প্রতিকার পাওয়ারও বিভিন্ন জায়গা তৈরি হয়েছে।

দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, সহিংসতার শিকার হলেও অভিযোগ করার বিষয়ে সচেতন নন বেশির ভাগ নারী। দেশে নারীরা যাতে সহজে অভিযোগ জানাতে পারেন, তার জন্য ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ উদ্যোগটিতে পুলিশের নারী সদস্যরা অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত এবং পরামর্শ দেওয়াসহ সব দায়িত্ব পালন করছেন।

অনলাইনে সহিংসতা ও সাইবার হয়রানির শিকার হলে আইনি সহায়তা নেওয়ার জন্য কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন, সাইবার পুলিশ সেন্টার, হ্যালো সিটি অ্যাপ, রিপোর্ট টু র‍্যাব অ্যাপ, ৯৯৯ এবং প্রতিটির ফেসবুক পেজেও অভিযোগ জানানো যায়। শিশুদের সহায়তায় ১০৯৮ নম্বরে, নারী ও শিশুদের সহায়তায় ১০৯ হটলাইনে ফোন করেও সেবা নেওয়া যায়।

চলতি বছরের মে মাসেই অভিনয়শিল্পী আশনা হাবিব ভাবনা গণমাধ্যমে খবরের শিরোনাম হন। তিনিও মা দিবসে মা ও বোনের সঙ্গে একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে মাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। পোস্টের নিচে এসে জড়ো হয় বেশ কিছু অশালীন মন্তব্য। তবে এ ঘটনার প্রতিকারও পেয়েছেন এ অভিনয়শিল্পী। পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট বিরূপ মন্তব্যকারী এক তরুণকে খুঁজে বের করে এবং সেই তরুণ তাঁর কৃতকর্মের জন্য ভাবনা ও তাঁর পরিবারের উদ্দেশে ফেসবুকে ক্ষমা চাওয়ার ভিডিও পোস্ট করেন।

২০১৯ সালের আগস্ট মাসে শিশুদের নিরাপদ ইন্টারনেট দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে শিশুদের জন্য ক্ষতিকর, অশ্লীল, আপত্তিকর ওয়েবসাইট ও হরর গেম বন্ধে কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না, তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। অর্থাৎ বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর অনলাইন নিরাপত্তার বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। ইন্টারনেট নিরাপদ করতে সরকার পর্নো সাইট, জুয়া খেলার সাইট বন্ধ করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।


লড়াই করছেন অনেকেই
গত বছরের শেষের দিকে আলোচনায় আসেন নড়াইলের শিক্ষার্থী সাদাত রহমান। আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার বিজয়ী সাদাত ঘোষণা দিয়েছেন, যত দিন সাইবার বুলিং বন্ধ না হয়, তত দিন তিনি কাজ চালিয়ে যাবেন। গত বছর নেদারল্যান্ডসভিত্তিক ‘কিডস রাইটস ফাউন্ডেশন’ সাদাত রহমানকে শিশুদের নোবেলখ্যাত আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ঘোষণা করে। ‘সাইবার টিনস’ নামে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সাইবার বুলিং সম্পর্কে তরুণদের শিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালানোর জন্য তিনি এ পুরস্কার পান।

ক্রাইম রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ফাউন্ডেশন-ক্র্যাফের প্রেসিডেন্ট জেনিফার আলম। তাঁর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি সাইবার অপরাধের শিকার ব্যক্তি (ভিকটিম) এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবেও কাজ করছেন।

স্টার কম্পিউটার সিস্টেমস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজওয়ানা খান সাইবার খাতে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিপর্যায়ে নিরাপত্তার জন্য ডিভাইস ও সেবা চালু করেছেন।

ডিজিটাল পরিবেশে শিশুদের জন্য নিরাপদ অনলাইন অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করতে গ্রামীণফোনের ফ্ল্যাগশিপ উদ্যোগ হচ্ছে ‘চাইল্ড অনলাইন সেফটি প্রোগ্রাম’। ২০১৪ সাল থেকে গ্রামীণফোন শিক্ষক, শিশু ও অভিভাবকদের নিরাপদ ইন্টারনেট পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে নানা কর্মসূচি পালন করছে। ২০১৮ সাল থেকে ইউনিসেফের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে নিরাপদ ইন্টারনেট বিষয়ে কাজ শুরু করেছে।

প্রথম আলো সারা বছরই গোলটেবিল বৈঠক (করোনার সময় ভার্চ্যুয়াল বৈঠক) আয়োজন, প্রতিবেদন, মতামত প্রকাশ, ভিডিও প্রচারসহ বিভিন্নভাবে সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির কাজ করছে।

গত বছর প্রকাশিত সাইবার নিরাপত্তা সূচকে (ন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি ইনডেক্স-এনসিএসআই) আগের ৭৩তম অবস্থান থেকে ৬৫তম স্থানে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। তালিকায় স্থান পাওয়া দেশগুলোর মৌলিক সাইবার হামলা প্রতিরোধে প্রস্তুতি এবং সাইবার ঘটনা, অপরাধ ও বড় ধরনের সংকট ব্যবস্থাপনায় তৎপরতা মূল্যায়ন করে সূচকটি তৈরি করেছে এনসিএসআই।

অস্বস্তিজনক পরিসংখ্যানের পাশাপাশি সচেতন হয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার ও হয়রানির শিকার হলে আইনি প্রতিকারের বিষয়টিতেই গুরুত্ব দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।