Thank you for trying Sticky AMP!!

সাধারণের মনেও গুমের শঙ্কা

‘গুমের শঙ্কা আর উদ্বেগ এখন অরাজনৈতিক সাধারণ মানুষের মনেও ঢুকে গেছে। এই সভা থেকে বের হওয়ার পর কী হবে, এরপর আর কোনো সভায় অংশ নিতে পারব কি না, তারই কোনো নিশ্চয়তা নেই।’

২০১৭ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে গিয়ে গতকাল রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে এভাবে উদ্বেগের কথা বললেন বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা। একটি স্বাধীন কমিশন করে গুপ্তহত্যা, গুমসহ সব বিচারবহির্ভূত হত্যার স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক তদন্তের দাবি জানিয়েছে আসক।

আসকের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর মোট ৯১ ব্যক্তি নিখোঁজ হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে এখনো ৫৮ জনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। বাকিদের মধ্যে দুজনের লাশ পাওয়া গেছে। ১৬ জন পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন। ১৫ জনকে পরে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার দেখিয়েছে।

গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আসকের সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য-উপাত্ত উল্লেখ করার সময় বলা হয়, ২০১৭ সালে মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল ‘চরম উদ্বেগজনক’। এর আগের বছরের (২০১৬ সাল) মানবাধিকার পরিস্থিতিকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে উল্লেখ করেছিল সংস্থাটি। এবার এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘চরম’ শব্দটি।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আসকের সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ২০১৭ সালে নিখোঁজ হওয়া ৯১ জনের মধ্যে ৬০ জনকে ধরে নেওয়া হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে। তাঁদের মধ্যে দুজনের লাশ পাওয়া যায় পরে। ৮ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ৭ জন পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন। বাকিরা এখনো নিখোঁজ। অবশ্য এর মধ্যে বিএনপির নেতা ও ব্যবসায়ী সৈয়দ সাদাত আহমেদকে ধরে নেওয়ার চার মাস পর গত শনিবার রাতে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গ্রেপ্তার দেখানোর তালিকায় সাদাতের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলে আসক জানায়। কারণ, তার আগেই তালিকাটা চূড়ান্ত করা হয়। সাদাতের নাম বাদ দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে এখনো নিখোঁজ ৪২ জন। এর বাইরে আরও ৩১ জন রহস্যজনক নিখোঁজ। যাঁদের মধ্যে ৯ জন পরে ফিরে এসেছেন, ৬ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। বাকি ১৬ জন এখনো নিখোঁজ।

প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম গতকাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে কিংবা রহস্যজনক গুম বা নিখোঁজের ঘটনাসহ মানবাধিকার নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। তাঁর মতে, সারা দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশ ২০১৭ সালে অনেক ভালো ছিল। তবে দ্রুত উন্নয়নের যে ব্যথা-বেদনা থাকে, সেগুলো বাংলাদেশেও হচ্ছে। এ নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই।

আসক বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনার পাশাপাশি গত বছর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নিখোঁজ হওয়ার ক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা। সাবেক রাষ্ট্র্রদূত থেকে সরকারি কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রকাশক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, রাজনৈতিক দলের নেতা, পৌর মেয়র—কেউই বাদ পড়েননি গুম-নিখোঁজের তালিকা থেকে।

এ ছাড়া বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় গত বছরও অব্যাহত ছিল বিভিন্ন বাহিনীর ক্রসফায়ার, গুলিবিনিময় ও বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। গত বছর কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ১২৬ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের কারণে নিহত হন ১২ জন। কারা হেফাজতে মারা গেছেন আরও ৫৩ জন।

আসকের সংবাদ সম্মেলনে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগের সমালোচনা করে বলা হয়, ২০১৭ সালে এই ধারায় সাংবাদিক, লেখকসহ ৫৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ ধারা বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন মহল সোচ্চার থাকলেও এর অপপ্রয়োগ থেমে নেই।

অনেক প্রতিবাদের পরও সদ্য পাস হওয়া বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের সমালোচনা করেন আসকের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা। তিনি বলেন, ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে বিয়ের বয়স কমিয়ে এই আইন পাসের তোড়জোড় শুরু হয়। আর ওই সময় থেকেই বেড়ে যায় শিশু নির্যাতনের সংখ্যা।

প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে বলা হয়, এই আইনে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার সমরূপ বিধান রাখায় স্বাধীন মতপ্রকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। আর খসড়া স্বাস্থ্যসেবা আইনের ২৫ ধারায় চিকিৎসকদের দায়মুক্তির যে বিধান রাখা হয়েছে, তা নিয়ে এর মধ্যেই আপত্তি উঠেছে।

সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ফেসবুক ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে উসকানি দিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালাচ্ছে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এ বছর হিন্দুদের ২১২টি প্রতিমা, ৪৫টি বাড়িঘর ও ২১টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় ১ জন নিহত ও ৬৭ জন আহত হয়েছেন।

সভা-সমাবেশের অধিকার বাধাগ্রস্ত

সভা-সমাবেশের সাংবিধানিক অধিকার বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে উল্লেখ করে আসক বলেছে, গত ২০ জুলাই সাতটি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেলের আঘাতে দুই চোখ হারান তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমান। সভা-সমাবেশ পণ্ড করতে পুলিশ ‘সাউন্ড স্টিমুলেটর’ নামে উচ্চশব্দ সৃষ্টিকারী যে যন্ত্রটি ব্যবহার করছে, তার সমালোচনা করে বলা হয়, এত উচ্চ শব্দে হার্ট অ্যাটাক বা উচ্চ রক্তচাপে মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন চিকিৎসকেরা। এ ছাড়া ২৮ অক্টোবর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ দিতে কক্সবাজারে যাওয়ার সময় বিএনপির চেয়ারপারসনের গাড়িবহরে হামলার সমালোচনা করা হয়।

আসকের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দেশের নারী অধিকার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। ২০১৬ সালে দেশে ৬৫৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। গত বছর ধর্ষণের শিকার হন ৮১৮ জন। ধর্ষণের পর ৪৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ফতোয়ার শিকার হয়েছেন ১০ জন নারী। ফতোয়ার পর ৩ জনকে দোররা মারা হয়েছে। অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ৩২ জন নারী।

শিশু নির্যাতন পরিস্থিতিও ছিল উদ্বেগজনক। গত বছর ১ হাজার ৩৩৯টি শিশু খুন এবং বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৬৭৫টি শিশু।

পার্বত্য চুক্তির ২০ বছরেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি উল্লেখ করে বলা হয়, বিগত বছরগুলোর মতো এ বছরও পাহাড়ে আদিবাসীদের ঘরবাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, হয়রানি, ভূমি দখল ও উচ্ছেদের অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আসকের হিসাবে গত বছর কর্মক্ষেত্রে ৩০৫টি দুর্ঘটনায় ৪০৫ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। ৪৩ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয় গৃহকর্তার বাড়ি থেকে।

দেশের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে আসক। সংস্থাটি বলেছে, চিকিৎসাক্ষেত্রে নৈরাজ্য, চিকিৎসক ও চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবহেলা ও ত্রুটি এবং চিকিৎসা না পেয়ে রোগীর মৃত্যু এবং ভোগান্তির অনেক অভিযোগ গত বছর পাওয়া গেছে।