Thank you for trying Sticky AMP!!

সাহেদের ভঙ্গুর রিজেন্ট হাসপাতাল ছিল অধিদপ্তরের ভরসা

রিজেন্ট হাসপাতালের ফাইল ছবি

রিজেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসক নেওয়া হবে, ফেসবুকে মো. সাহেদের এমন পোস্ট দেখে যোগাযোগ করেন এক নারী চিকিৎসক। এই হাসপাতালের মিরপুর শাখায় চাকরি হলেও মাস দেড়েক পর তিনি পালিয়ে আসেন। ঘুমানো ছাড়া দিনের বাকি সময় পুরোটাই তাঁকে কাজ করতে হতো। ওই হাসপাতালে তখন তিনিই ছিলেন একমাত্র চিকিৎসক। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রীও সেখানে ছিল না।

কিন্তু জোড়াতালির এই হাসপাতালটিতেই ভরসা খুঁজে পায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। রিজেন্ট ও অধিদপ্তরের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে হাসপাতালটিকে একটি অত্যাধুনিক হাসপাতাল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।

ওই নারী চিকিৎসক এখন গুলশানের একটি হাসপাতালে কর্মরত আছেন। পাওনা টাকা আদায়ে মামলা করবেন বলে এখনই নাম প্রকাশ করতে চাননি। তিনি বলেন, তাঁর চাকরি হওয়ার এক মাস পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সেখানে চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর তিনি এক ভোরবেলায় পালিয়ে আসেন। কিন্তু ১০ দিন পর গাড়ি পাঠিয়ে তাঁকে আবারও নিয়ে যাওয়া হয়। এবার তাঁকে উত্তরা শাখায় নিয়োগ দেওয়া হয়। দৈনিক আট কর্মঘণ্টা হিসেবে মাসিক বেতন ৫০ হাজার টাকা ঠিক হলেও দেড় মাস পর তাঁকে দেওয়া হয় ৩০ হাজার টাকা। একপর্যায়ে তিনি উত্তরা থেকেও পালিয়ে আসেন। তিনি জানান, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরাও সেখানে থাকতে পারেননি।

রিজেন্ট হাসপাতালের মিরপুর ও উত্তরা শাখায় চিকিৎসক–সংকট ছাড়া আর কী কী সমস্যা ছিল, তা জানতে দুজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, কাগজে–কলমে হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) থাকলেও তাঁরা কোনো ভেন্টিলেটর বা কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিন দেখেননি। 

সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা থাকলেও নিরবচ্ছিন্নভাবে অক্সিজেন সরবরাহ চলছে, সেটা দেখার মতো জনবল ছিল না। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে অন্যের মুখ থেকে মাস্ক খুলে গুরুতর অসুস্থ কাউকে দিয়ে জীবন রক্ষা করতে হয়েছে। হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। যে প্রতিবেদন সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া দরকার ছিল, সেটা হাতে আসত দুদিন পর।

একজন চিকিৎসক বলেন, রিজেন্ট থেকে যে ভুয়া করোনা সনদ দেওয়া হচ্ছিল, সেটা তাঁরা জানতেন না। তবে তাঁরা প্রায়ই এমন রোগী পাচ্ছিলেন, যাঁদের রোগের লক্ষণ দেখে করোনায় আক্রান্ত বলে মনে হতো। কিন্তু রিপোর্ট ছিল নেগেটিভ। তাঁরা অনেক রোগীকে বাইরে থেকে পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কিংবা রোগের লক্ষণ দেখেও চিকিৎসা করিয়েছেন।

চিকিৎসকেরা থাকতেন কোথায়, খাওয়াদাওয়াই–বা কোথায় করতেন, এমন প্রশ্নে তাঁরা জানান, হাসপাতালে চেয়ারম্যানের কক্ষে তোষক ফেলে তাঁদের থাকতে দেওয়া হয়েছিল। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকেরা টানা এক সপ্তাহ কাজ করেন, এক সপ্তাহ হোটেলে আইসোলেশন এবং এক সপ্তাহের জন্য বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ পান। তাঁরা কখনোই সেটা পাননি। প্রতি রাতে ১২টার পর চেয়ারম্যান অস্ত্রধারী দেহরক্ষীদের নিয়ে হাসপাতালে আসতেন। তারপর বৈঠক করতেন। বেতন-ভাতার কথা ছাড়া সবই বলতেন।

একজন চিকিৎসক ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছেন। খুলনায় নিজের বাড়িতে ছিলেন। রিজেন্ট কর্তৃপক্ষের অনুরোধে তিনি আরও দুই চিকিৎসককে নিয়ে আসেন। সাহেদ তাঁদের উড়োজাহাজে করে চলে আসতে বলেন। কিন্তু মাস শেষে বেতন পাননি, বিমানভাড়াও নিজেদের পকেট থেকে দিতে হয়েছে।

চুক্তিতে যা ছিল 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে রিজেন্ট হাসপাতালের চুক্তির মেয়াদ ছিল মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ওই চুক্তিতে বলা হয়, দেশের ‌বিশৃঙ্খল স্বাস্থ্যব্যবস্থায় রিজেন্ট হাসপাতাল একটা মহতী উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। তাদের স্লোগান ‌‘সেবা সব সময়’। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সাধারণ চিকিৎসক, নার্স, প্যারামেডিক, অত্যাধুনিক বায়োমেডিকেল যন্ত্রপাতি নিয়ে তারা এগিয়ে এসেছে।

চুক্তিতে আরও বলা হয়, রিজেন্টের মিরপুর ও উত্তরার দুটি হাসপাতালে সব ধরনের সেবার ব্যবস্থা আছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরি ও রেডিওলজি বিভাগ রয়েছে। ‘মিলিনা’ নামে তাদের একটি হোটেল আছে। সেখানে ৩৬টি কক্ষে স্বাস্থ্যকর্মীদের কোয়ারেন্টিনে থাকার ব্যবস্থা আছে। তিনটি অ্যাম্বুলেন্সে সব সময় রোগী পরিবহনের ব্যবস্থা আছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো যেকোনো রোগীকে বিনা মূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার কথা ছিল রিজেন্টের। এর সব ব্যয় মেটানোর কথা অধিদপ্তরের।

কিসের ভিত্তিতে অধিদপ্তর এই সনদ দিয়েছিল রিজেন্ট হাসপাতালকে, তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অধিদপ্তর দায় চাপাচ্ছে মন্ত্রণালয়কে, মন্ত্রণালয় দায় চাপাচ্ছে অধিদপ্তরকে।

সাহেদের মামলা র‌্যাবে, দুদকের মামলার প্রস্তুতি

রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত করবে র‌্যাব। র‌্যাবের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অনুমোদন দেয়। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন।

এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাহেদসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিয়েছে। এ মামলায় সাহেদ ও হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইব্রাহিম খলিল ছাড়াও এনআরবি ব্যাংকের দুই কর্মকর্তাকে আসামি করা হচ্ছে। দুদক বলেছে, ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকের ১ কোটি ৫১ লাখ ৮১ হাজার ৩৬৫ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় এই চারজন জড়িত।

আসামিদের বিরুদ্ধে দুদকের অভিযোগে আরও বলা হয়, রিজেন্ট হাসপাতালের চলতি হিসাবটি খোলার সময় গ্রাহকের কাছ থেকে কোনো টাকা জমা নেওয়া হয়নি। মো. সাহেদ এনআরবি ব্যাংকের নতুন গ্রাহক। তিনি ২০১৪ সালের ১৭ নভেম্বর ব্যাংক হিসাবটি খোলেন। কিন্তু হিসাব খোলার আগের দিনই ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা সোহানুর রহমান ও ওয়াহিদ বিন আহমেদ সাহেদের জন্য এসএমই ব্যাংকিং ঋণ মঞ্জুরির সুপারিশ পাঠান। ঋণ মঞ্জুরির আগপর্যন্ত ওই হিসাবে কোনো লেনদেন ছিল না। মো. সাহেদের হাসপাতাল ব্যবসার পূর্ব–অভিজ্ঞতাও ছিল না। অন্য কোনো ব্যাংকে বা অন্য কোনো ব্যবসায় সাহেদের কোনো ধরনের বিনিয়োগ বা লেনদেন ছিল কি না, সে সম্পর্কেও কোনো তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি। এমনকি ঋণের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত জামানত গ্রহণ করা হয়নি। ঋণ বিতরণের আগে বা পরে যথাযথ তদারক করা হয়নি।

অভিযোগে বলা হয়, ঋণের মঞ্জুরিপত্রের শর্তানুযায়ী নির্ধারিত সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা হয়নি। সাহেদ রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে ঋণ মঞ্জুরিপত্রের শর্তানুযায়ী এফডিআর করেছিলেন। পরে সাহেদ ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংক এফডিআর ক্লোজ করে ঋণ সমন্বয় করে। এতে দেখা যায়, মো. সাহেদ স্বেচ্ছায় কখনো ঋণের টাকা পরিশোধ করেননি। তিনি অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের জন্য ঋণ গ্রহণ করেছিলেন।