Thank you for trying Sticky AMP!!

সিটি করপোরেশনের ৭৫ ভাগ এলাকায় নেই নগর-সুবিধা

দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন গাজীপুরের আয়তন ৩২৯ বর্গকিলোমিটার। গাজীপুর ও টঙ্গী এলাকা মিলিয়ে ৮০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যেই মূলত সীমিত নাগরিক সুবিধা। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা, নগরবাসীর সঙ্গে কথা বলে ও সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, আয়তনে বড় হলেও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অন্তত ৭৫ শতাংশ এলাকার মানুষ নগর-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

টঙ্গী স্টেশন রোড থেকে বাঁয়ে বনমালা-ধীরাশ্রম সড়ক ধরে জয়দেবপুর যাওয়া যায়। টঙ্গীর বনমালা রেলগেট পার হলে টানা কয়েক কিলোমিটার রাস্তার দুই পাশে ধানখেত। সন্ধ্যা হলে ঝিঁঝি পোকার ডাক। হায়দরাবাদ নামের এই এলাকা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড।

গত সপ্তাহে কথা হয় হায়দরাবাদ এলাকার দোকানি মো. আব্বাসের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সিটি হওয়ার পর শুধু এই ধীরাশ্রম সড়ক হয়েছে, তাও অসম্পূর্ণ। পানির লাইন নেই, ড্রেন নেই, গৃহস্থালির বর্জ্য নেওয়া হয় না, ভেতরে রাস্তাঘাট ভাঙা, সড়কবাতি কিছু লাগিয়েছিল, কিন্তু সেগুলো কাজের নয়। তবু সবাইকে কর দিতে হচ্ছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এসব কইলেই কী, আর আপনে লেখলেই কী! কিছুই হইবো না।’ পাশ থেকে আরেকজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি বলেন, সিটি হওয়ায় তাঁরা কাউন্সিলর পেয়েছেন, লাভ হয়েছে শুধু এটাই।

২০১৩ সালের জানুয়ারিতে সাবেক টঙ্গী ও গাজীপুর পৌরসভা এবং গাজীপুর সদর উপজেলার কাশিমপুর, কোনাবাড়ী, বাসন, পুবাইল, গাছা ও কাউলতিয়া ইউনিয়ন ভেঙে গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠন করা হয়। এখানে মোট ওয়ার্ড ৫৭টি। যে ইউনিয়নগুলো ভেঙে সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবখানেই নগর-সুবিধা নেই।

টেকনগপাড়ার (১৮ নম্বর ওয়ার্ড) বাসিন্দা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাকিব আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করা হলে আগের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ে সিটি করপোরেশনের কোনো পার্থক্য নেই। তাঁরা বাড়তি কোনো ধরনের সুবিধা পাচ্ছেন না।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, শহরে মোট রাস্তা প্রয়োজন অন্তত ৫ হাজার ৩৩৬ কিলোমিটার। কিন্তু রাস্তা আছে ২ হাজার ২১১ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৬১৩ কিলোমিটার অর্থাৎ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রাস্তা মাটির। এ ছাড়া পাকা রাস্তা ৬৭১ কিলোমিটার, ঢালাই রাস্তা (আরসিসি ও সিসি মিলিয়ে) ১৮৪ কিলোমিটার, ইটের রাস্তা ৭৪২ কিলোমিটার। নর্দমা প্রয়োজন অন্তত ৪ হাজার ৯৬৬ কিলোমিটার, আছে মাত্র ১ হাজার ১১০ কিলোমিটার।

>দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন গাজীপুর
নগরবাসীর আরেক সঙ্গী নানা ধরনের দূষণ আর যানজট

গাজীপুর সিটিতে মোট হোল্ডিং আছে ১ লাখ ২৯ হাজার ৫৬৪টি। এর মধ্যে পানির সংযোগ আছে মাত্র ১১ হাজার ৮৯৫টিতে। মোট পানির পাইপলাইন আছে মাত্র ১১৯ কিলোমিটার। নগরবাসীর পানির জন্য ভরসা টিউবওয়েল। সিটি করপোরেশনের হিসাবে সব মিলে প্রায় ১ হাজার ২৪৮টি চাপকল আছে। সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কোনো মাঠ নেই, পার্ক নেই। নগরবাসীর চিত্তবিনোদনের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। শহরের মূল মাঠ রাজবাড়ি মাঠটি বেশির ভাগ সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দখলে থাকে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র ছিলেন বিএনপির মনোনীত প্রার্থী আবদুল মান্নান। তাঁর মেয়াদের একটি বড় সময় তিনি কারাগারে ছিলেন। দ্বিতীয় নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর আলম। সাত মাস আগে গত সেপ্টেম্বরে তিনি মেয়রের দায়িত্ব নেন।

বেশির ভাগ মানুষ নাগরিক সুবিধার বাইরে থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা একটি মহাপরিকল্পনা করে কাজে হাত দিয়েছেন। পরিবেশের ওপর গুরুত্ব দিয়ে অবকাঠামো, রাস্তাঘাট প্রশস্ত ও টেকসই করা, ড্রেন নির্মাণসহ সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হবে। আটটি খাল খনন করা হচ্ছে। ৭০০ কিলোমিটার রাস্তার কাজ শুরু হয়েছে। এগুলো হতে কিছু সময় লাগবে, ২-৩ বছরের প্রকল্প। আগামী ডিসেম্বর-জুন নাগাদ কাজ দৃশ্যমান হবে। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে ৪০-৫০ বছর ধরে কাজ হচ্ছে, তারপরও সেখানে নানা সংকট। আর গাজীপুর সিটি করপোরেশন মাত্র যাত্রা করেছে। শিববাড়ি থেকে জয়দেবপুর ফ্লাইওভার, কাশিমপুর থেকে বাসন কোনাবাড়ী সংযোগ, তুরাগ নদের ওপরে আরও তিনটি সেতু করার জন্য জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সঙ্গে মৌখিক আলোচনা হয়েছে। সুয়ারেজ ব্যবস্থা উন্নত করতে কয়েকটি দাতা সংস্থা ৪৫০ কোটি টাকা দেবে।

নগরবাসীর আরেক সঙ্গী নানা ধরনের দূষণ আর যানজট। সিটি করপোরেশন এলাকায় হাজারখানেক ছোট-বড় কলকারখানা আছে। স্থানীয় লোকজন বলছেন, গাজীপুরের প্রধান নদ-নদী তুরাগ, লবলং, মকশ বিল, বেলাই বিল শিল্পদূষণের শিকার। বায়ুদূষণে ঢাকার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে এই শহর। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বলে তেমন কিছু গড়ে ওঠেনি। পুরো শহরই যেন ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক হয়ে টঙ্গীর মানুষকে প্রশাসনিক এলাকা জয়দেবপুর যেতে হয়। এই রাস্তার নিত্যসঙ্গী যানজট আর ধুলা। টঙ্গী থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে কখনো কখনো দু-তিন ঘণ্টাও লেগে যায়।

ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের শিক্ষক অসীম বিভাকর মনে করেন, নগরের প্রধান সমস্যা অপরিকল্পিত শিল্পায়ন। মানুষ একটি দূষণের কুণ্ডলীর মধ্যে বসবাস করছে। র‍্যাপিড বাস ট্রানজিট, ফ্লাইওভারের প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে নগরবাসী কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে বলে তিনি আশা করেন।

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যেহেতু গাজীপুরকে সিটি করপোরেশন করা হয়েছে, সেহেতু নগরের সেবা, সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এটি পুরোপুরি করতে একটু সময় লাগবে। কিন্তু দেখতে হবে কত তাড়াতাড়ি পরিকল্পিতভাবে এ সেবা নিশ্চিত করা যায় এবং তাদের পরিকল্পনা কী।