Thank you for trying Sticky AMP!!

সিলিকোসিসের ঝুঁকিতে পাথরভাঙা শ্রমিক

পাটগ্রামের বুড়িমারী স্থলবন্দর এলাকায় পাথরভাঙা শ্রমিকদের সাবেক সর্দার মমিনুর রহমান। ভুগছেন মরণব্যাধি সিলিকোসিসে। তাঁর অধীনে ২০ জন শ্রমিক কাজ করতেন। তাঁদের মধ্যে এ রোগে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। জীবন বাঁচাতে এ পেশা ছাড়েন মমিনুর।
শনাক্ত হওয়ার পর গত সাড়ে আট বছরে সিলিকোসিসে আক্রান্ত ৫৫ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। মমিনুরের মতো সবাই এ কাজ ছাড়তে পারেননি। বর্তমানে স্থলবন্দর এলাকায় পাঁচ শতাধিক যন্ত্রে পাথর ভাঙা হয়। এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে সেখানে প্রতিদিন কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এ রোগ প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না।
সাবেক শ্রমিক সর্দার ও বুড়িমারী স্থলবন্দর পাথরভাঙা শ্রমিক সুরক্ষা কমিটির সভাপতি মমিনুরের (৪০) বাড়ি বুড়িমারী ইউনিয়নের উপরমারা গ্রামে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হতদরিদ্র শ্রমিকেরা পেটের দায়ে কাজ করেন। স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি তাঁরা খুব একটা আমলে নেন না। এই গ্রামের আরও অন্তত ৫০ জন শ্রমিক সিলিকোসিস রোগে ভুগছেন। অন্য শ্রমিকদের মরতে দেখে তাঁর খুব খারাপ লাগে। এই তো ৯ এপ্রিল রাজু মিয়া (২৮) নামের এক শ্রমিকের মৃত্যু তাঁকে নাড়া দেয়।
মমিনুর বলেন, রাজু তাঁর অধীনেই কাজ করতেন। বাড়ি উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নের ঘুন্টিঘর গ্রামে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সিলিকোসিস রোগে ভুগছিলেন। প্রথমে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। কিন্তু তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। শেষমেশ জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজুর মৃত্যু হয়।
দেশে প্রথম ২০১২ সালে বুড়িমারী স্থলবন্দরে রোগটি শনাক্ত হয়। রোগটি নিয়ে ২০১২ সালের আগস্ট মাসে স্থানীয় উপজেলা হলরুমে সেমিনারের আয়োজন করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)। সেখানে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা এ রোগের ভয়াবহতা তুলে ধরেন। বিলস ২০১২ সালে দুই দফায় বুড়িমারীর ৩৮৬ জন শ্রমিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করে। এর মধ্যে ১০০ জন সিলিকোসিসে আক্রান্ত ছিলেন।
ওই সময় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের গবেষক ফজলে রাব্বী বলেছিলেন, সিলিকোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাইরে থেকে স্বাভাবিক দেখা যায়। কিন্তু ভেতরে তাঁদের ফুসফুস পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। এ রোগে আক্রান্ত হলে শরীর ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে থাকে। রোগীর শ্বাসকষ্ট হয়। কাশি, জ্বর ও ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেয়। শুরুতেই এর চিকিৎসা করা না হলে পরে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।
গতকাল মঙ্গলবার বুড়িমারী স্থলবন্দরে সরেজমিনে দেখা যায়, লালমনিরহাট-বুড়িমারী স্থলবন্দর মহাসড়কের দুই পাশে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে খোলা আকাশের নিচে পাঁচ শতাধিক যন্ত্রে পাথর ভাঙার কাজ চলছে। অন্তত চার হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিক সেখানে কাজ করছেন। এসব শ্রমিকের মুখে মাস্ক নেই। ধুলাবালু সরাসরি নাকে ঢুকছে। ধুলাবালু বাতাসের সঙ্গে মিশে পুরো এলাকা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। মহাসড়ক দিয়ে চলাফেরা করা মানুষজন নাকে রুমাল চেপে ওই এলাকা পার হচ্ছে।
যাদু মিয়া (৬০), শাহ আলমসহ (২৮) অন্তত ১০ জন শ্রমিক বলেন, ভারত থেকে পাথর আমদানি করা হয়। পরে ভেঙে ট্রাকে করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়। পাথর ভাঙার নানা ধরনের যন্ত্রে কাজ করে একজন শ্রমিক প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা উপার্জন করেন। পাটগ্রাম সদরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার অভাবী মানুষ এখানে কাজ করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তাঁরা বলেন, ‘রোগটোক বুঝি না। এলা সংসারের ছোয়াপোয়া (ছেলেমেয়ে) বাঁচাই আগোত। তারপর মরণের কথা জানিম। কাজ করলে রোগবালাই তো হবে। সে জন্য কি কাজ বাদ দিয়া বসি থাকিলে বাঁচা যাবে?’
আরেক সাবেক শ্রমিক সর্দার মতিউল ইসলাম (৩৮) বলেন, তাঁর অধীনে ১৬ শ্রমিক বুড়িমারী স্থলবন্দরে পাথর ভাঙার কারখানায় চার-পাঁচ বছর ধরে কাজ করার পর সিলোকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি নিজেও এ রোগে ভুগছেন। মার্চ মাসে হামিদুলসহ তাঁর দলের ১১ শ্রমিক মারা গেছেন। বর্তমানে তিনিসহ পাঁচজন এ রোগে ভুগছেন। ২০১২ সালে তাঁর এ রোগ ধরা পড়ে। প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। এরপর পাথর ভাঙার কাজ ছেড়ে দেন। তিনি নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু সাইদ নেওয়াজ বলেন, ২০১২ সালে বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা এসে রোগটি শনাক্ত করেন। কিন্তু এই রোগ প্রতিরোধে তখন থেকে সরকারিভাবে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
গতকাল জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম মোহাম্মদ বলেন, এ রোগে আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা তাঁদের জানা নেই। তবে গত বছরের অক্টোবরে জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ‘সিলোকোসিস স্বাস্থ্য’ ক্যাম্প করা হয়েছিল। তখন নতুন করে এ রোগে আক্রান্ত ৩০ শ্রমিক পাওয়া যায়।
জেলা সিভিল সার্জন আমিরুজ্জামান বলেন, ‘এ জেলায় নতুন যোগ দিয়েছি। শুনছি এ রোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েকজন মারা গেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূর কুতুবুল আলম বলেন, এ রোগে আক্রান্ত হয়ে শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনা দুঃখজনক। এ ক্ষেত্রে পাথর গুঁড়া করার মেশিনের বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান নেওয়া হবে। গতকাল সকালে স্থলবন্দর এলাকায় অভিযান চালিয়ে যন্ত্রের সাহায্যে পাথর ভাঙায় জড়িত পাঁচ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে মোট ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।