Thank you for trying Sticky AMP!!

সুধীন দাশ সুরের আকাশে শুকতারা

>
সুধীন দাশ। ছবি: খালেদ সরকার

প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ সুধীন দাশ। ২৭ জুন গত হলেন তিনি। ২০১০ সালে তাঁকে মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার দেওয়া হয়। এ উপলক্ষে ২০১০ সালের ১০ এপ্রিল প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’ ক্রোড়পত্রে গুণী এই মানুষটিকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতিবেদনটি আবার প্রকাশ করা হলো :

আর কদিন পরই ৮০ বছর পূর্ণ করছেন। ফেলে আসা জীবনের পুরোটাই তিনি দিয়েছেন গানের পেছনে। গান গেয়েছেন সুর করেছেন, কাজ করেছেন সংগীতপরিচালক হিসেবে, গবেষণা তো বটেই। বাংলা গানের ধ্রুবতারা কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকে শ্রোতার কাছে শুদ্ধরূপে পৌঁছে দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তিনিই করেছেন। তিনি সুধীন দাশ। ১৯৮৮ সালে একুশে পদক পাওয়ার পাশাপাশি পেয়েছেন বহু পুরস্কার, সম্মাননা। এবার পেলেন মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা।

আমার গহিন জলের নদী
দীপ ছেলেটির বয়স আট বছর। ভারি চঞ্চল! লাফঝাঁপ ছাড়া কথা নেই তার। দোতলার বসার ঘরটায় তখন বৈদ্যুতিক পাখাটা বিরামহীনভাবে শোঁ শোঁ করে ঘুরছে। আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে টুং টাং করে মিষ্টি সুর তুলছে ছাদে ঝোলানো একটা উইন্ড ব্রেকার। সে সময় হঠাৎ পর্দার ওপাশ থেকে হা রে রে রে করে ছুটে আসে দস্যি ছেলে দীপ। ব্যস, মুহূর্তেই লঙ্কাকাণ্ড! ঘরের সেই সুনসান ভাবটা কর্পূরের মতো উবে যায়! ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি?’ বেশ রেগেমেগে প্রশ্ন করেন দাদুভাই, ‘আমার ড্রয়ারের চাবিটা কোথায় রেখেছ? আমি তো খুঁজে খুঁজে হয়রান!’ প্রশ্নটাকে থোড়াই কেয়ার করে এক লাফে মেঝেতে রাখা হারমোনিয়ামটা পেরিয়ে যায় দীপ। লাফাতে লাফাতে উত্তর দেয়, ‘কেন, তোমার বিছানার ওপরই তো রেখেছি!’ দাদু তখন খানিকটা দমে এসেছেন, ‘আচ্ছা, ভালো করেছ। এখন যাও, হাত-মুখ ধুয়ে মানুষ হও।’ ঝড়ের মতো এসেছিল, ঝড়ের মতোই বিদায় নেয় দীপ। পর্দার ওপাশে ওর মিলিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে দাদুর মুখের কপট রাগ তখন হাসিতে রূপান্তরিত হয়েছে। গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলেন, ‘বেজায় দুষ্টু! কিন্তু ওর এই দুষ্টুমিই আমার ভালো লাগে। সামনে তো বলা যায় না। আসলে ওরা আছে বলেই এই বয়সেও ভালো আছি।’ হ্যাঁ, বার্ধক্যজনিত হাজারটা সমস্যা আছে। তবুও গান আর তাঁর চারপাশের মানুষগুলো নিয়ে ভালোই আছেন দীপের দাদু, সুধীন দাশ। সংগীতশিল্পী সুধীন দাশ। সংগীতবিশেষজ্ঞ, সুরকার, সংগীতপরিচালক, গবেষকসহ আরও এমন অনেক পরিচয়ে পরিচিত তিনি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যে পরিচয়—তিনি আমাদের বাংলা গানের ধ্রুবতারা কাজী নজরুল ইসলামের গানের স্বরলিপিকার। গানপাগল একজন।

আমার আমি
আর মাত্র ১৯ দিন বাদেই, মানে ৩০ এপ্রিল সুধীন দাশের জন্মদিন। কাঁটায় কাঁটায় ৮০ বছরে পা রাখছেন। কুমিল্লা শহরের তালপুকুরপাড়ের বাগিচাগাঁওয়ে জন্মেছিলেন তিনি। সেটা ১৯৩০ সালের কথা। তিন বোন আর ছয় ভাইয়ের পর মায়ের কোলজুড়ে এসেছিলেন; বাবা নিশিকান্ত দাশ ও মা হেমপ্রভা দাশের আদর-স্নেহের বড় একটা অংশই তাঁর নামে বরাদ্দ ছিল। বড় ভাইবোনদের আদরও কম পাননি। তাই অতি আদরে যা হয়, ‘বাউণ্ডুলে’ তকমাটা বেশ শক্ত করেই সেঁটে গিয়েছিল তাঁর নামের সঙ্গে! তবে বাউণ্ডুলে হলে হবে কী, ‘পড়াশোনায় বেশ ভালোই ছিলাম, প্রথম না হলেও ক্লাসরোল থাকত ওপরের দিকেই।’ স্মৃতিতে থাকা পাঠশালাজীবনের খেরোখাতাটা মেলে ধরেন সুধীন দাশ, ‘পড়াশোনার প্রথম হাতেখড়ি হয়েছিল বামচন্দ্র পাঠশালায়। এরপর তৃতীয় শ্রেণিতে উঠে চলে যাই ঈশ্বর পাঠশালায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে সেই পাঠশালাটা বন্ধ হয়ে যায়। কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হই ভিক্টোরিয়া কলেজে।’ কলেজের চৌহদ্দি পেরোলে আসে বিএ পরীক্ষার ডাক। তবে তত দিনে পড়াশোনার চেয়ে অন্য বিষয়ে বেশি মন দিয়েছেন তিনি। এ সময় দাবা খেলাটাও প্রায় নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। তাই পরীক্ষার বেঞ্চে বসেও বসা হয় না, ‘পরীক্ষাটা আর দেওয়া হলো না শেষমেশ! তবে ছেলেবেলা থেকে চঞ্চল প্রকৃতির হলেও গানের ব্যাপারে দারুণ আগ্রহ ছিল।’ দেয়ালে টাঙানো বড় ভাই প্রয়াত সুরেন দাশের ছবিটা দেখিয়ে বলেন, ‘আমার সংগীতের প্রতি ভালোবাসার বীজটা কিন্তু আমার ওই বড় দাদাই বপন করেছিলেন। তিনিই আমার সংগীতগুরু। প্রথম প্রথম গান শেখাতে চাইতেন না তিনি। মা বলতেন, ছেলেটা যখন গান শিখতে চাইছে, তুমি বারণ করছ কেন? দাদার উত্তর, আগে পড়ালেখাটা করতে দাও, তারপর দেখা যাবে। দাদা ছেলেমেয়েদের গান শেখাতেন, আমি ঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে শুনতাম। সব শুনে ফাঁক পেলেই মাঠে গিয়ে গলা সাধতাম। একদিন ছাত্ররা গান তুলতে পারছে না, দাদা রেগে গেলেন—এত চেষ্টা করেও তোমাদের শেখাতে পারছি না, অথচ ঘরের পেছনে যারা ঘুরঘুর করছে, তারা তো ঠিকই শিখে চলে যাচ্ছে! ব্যস, আর কী চাই, সেই কথাগুলোই ছিল আমার সংগীতজীবনের বড় প্রেরণা। এরপর দীর্ঘদিন দাদার কাছে উচ্চাঙ্গসংগীতের তালিম নিয়েছি। তিনি গত হয়েছেন আজ প্রায় ১৮-১৯ বছর হলো, কিন্তু তাঁর সেই ভালোবাসা আর শিক্ষাই আমার জীবনের পাথেয় হয়ে আছে।’

দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার
‘এতক্ষণ শুনছিলেন আধুনিক বাংলা গান। কণ্ঠ ও সুর দিয়েছেন শ্রীসুধীন দাশ, গীতিকার ছিলেন শ্রীসত্যজিৎ সরকার।...’ হ্যাঁ, প্রথম দিনের গান শেষে এভাবেই ঘোষণাটা দিয়েছিলেন রেডিও পাকিস্তানের ঘোষক। এভাবেই সুধীন দাশের বেতারে গান গাওয়া শুরু। শুনুন তাঁর কাছ থেকেই—‘১৯৪৮ সালের ৮ মার্চের ঘটনা সেটা। দুটি গান গেয়েছিলাম সেদিন। সেই শুরু। এরপর নিয়মিত বেতারে গাইতে শুরু করলাম। তখন শিল্পী ছিল হাতে গোনা। মাসে চার দিন গাওয়ার সুযোগ পেলাম। তিন অধিবেশন মিলিয়ে অনেক গানই গাইতে হতো। রবীন্দ্রসংগীতই বেশি হতো, পাশাপাশি আধুনিক গান এবং রাগপ্রধান গানও থাকত। গান গাওয়ার সম্মানী হিসেবে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হতো ১০ টাকার একটা চেক। তখনো ঢাকায় থিতু হইনি, কুমিল্লা থেকে যাতায়াত করি। আসা-যাওয়া ও অন্যান্য খরচ বাদে সে সময় হাতে থাকত চার টাকার মতো। বেতারে তখন শিল্পীর পাশাপাশি সুরকারেরও বেশ শূন্যতা। তাই সুরকার হিসেবেও চাহিদা বেড়ে গেল আমার। আয়-রোজগার নেহাত মন্দ হচ্ছিল না। একটা গানের সুর করলে পাঁচ টাকা।’ তবে নিয়মিত গান ও সুর করতে থাকলেও মনে একটা খচখচ ভাব থেকেই যেত। কেন? ‘তখন নজরুলসংগীত বলে আলাদা কিছু ছিল না। আধুনিক বাংলা গান কিংবা রাগপ্রধান গান হিসেবে নজরুলের গান গাওয়া হতো। এটা বেজায় কষ্টের ছিল। আরও বেশি কষ্টের ছিল, নজরুল যখন একসময় নিদারুণ অর্থকষ্টে ছিলেন, তখন তাঁকে দেখার কেউ ছিল না। অথচ তিনি যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন, নির্বাক অচৈতন্য অবস্থা। জাগতিক চাহিদা বলতে যখন কিছুই নেই তাঁর, তখনই তাঁকে নিয়ে শুরু হলো রশি-টানাটানি খেলা! এই বাংলায় ওই বাংলায় ধুমছে নজরুলের গান বাজতে লাগল। ১৯৫৪-৫৫ সালের দিকে পাকিস্তান রেডিওতে নজরুলের গান আলাদাভাবে মর্যাদা পেল “নজরুলগীতি” হিসেবে। সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে যায় নজরুলগীতি। তবে সর্বনাশের শুরুটাও সেখান থেকেই। বারোটা বেজে যায় নজরুলের গানের কথা ও সুরের! যাঁরা জীবনেও নজরুলের গান করেননি, তাঁরাও নজরুলগীতি গাইতে শুরু করলেন জনপ্রিয়তার মোহে। নজরুল অসুস্থ থাকাকালীন তাঁর গানের প্রচার-প্রসার পুরোপুরি বন্ধ ছিল। নজরুলসংগীতের অন্ধকার সময় বলা যায় সে সময়টাকে। তো, তাতে করে সে সময় নজরুলের গান বেশ দুর্লভ হয়ে পড়ে। তাই কোনো কিছু না জেনে, না বুঝে বিকৃত সুর ও কথায় শিল্পীরা নজরুলের গান গাইতে থাকলেন। চূড়ান্ত বিভ্রান্তি যাকে বলে!’ একদিকে দেশে নজরুলের গান নিয়ে যথেচ্ছাচার, অন্যদিকে কলকাতা থেকে তখন প্রকাশিত হতে থাকে নজরুলের গানের ভুলে ভরা স্বরলিপি। নজরুলের একসময়ের কাছের বন্ধুরাই তা করতে শুরু করেন। এদিকে বিশেষ কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে নয়, ছেলেবেলা থেকে নজরুলের গানের আদি গ্রামোফোন রেকর্ড শুনে শুনে নজরুলসংগীত আত্মস্থ করেছিলেন সুধীন দাশ। নজরুলের গানের আদি ও অকৃত্রিম রূপটা ভালো করেই জানতেন। স্বভাবতই ভুলে ভরা স্বরলিপি দেখে আঁতকে ওঠেন তিনি। প্রতিবাদের ভাষা খুঁজতে থাকেন মনে মনে। তবে জানতেন, প্রতিবাদ করতে চাই যথাযথ প্রমাণ। তাই সুধীন দাশ নেমে পড়েন নজরুলের গানের আদি রেকর্ড সংগ্রহের কাজে। সংগৃহীত রেকর্ডের সঙ্গে স্বরলিপি মেলাতেই দেখেন, প্রতিবাদের জন্য যথেষ্ট শক্ত প্রমাণ তাঁর হাতে। দেরি না করে ছুটে যান কলকাতায়, সরাসরি প্রতিবাদ করতে। সেখানে তাঁর কথা আমলে নেয় না কেউ। দেশে ফিরে এসে ঢাকার অনেকের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেন তিনি। ‘কিন্তু না, এখানেও কেউ গা করে না বিষয়টিতে। সাধারণ শ্রোতা ভুলে ভরা গান শুনে শুনে অভ্যস্ত হতে থাকে। শেষে নজরুল একাডেমি এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা নেয়। অনেকের অনিচ্ছা সত্ত্বেও নজরুলের গানের শুদ্ধ স্বরলিপি প্রকাশের কাজ শুরু হয় এবং তার গুরুদায়িত্বটি আমার কাঁধেই বর্তায়। দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে স্বরলিপি তৈরি করতে থাকি। অবশেষে আলোর মুখ দেখে আমার কাজ। ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে ২৫টি স্বরলিপি নিয়ে নজরুল সুরলিপির প্রথম খণ্ডটি প্রকাশ করে নজরুল একাডেমি। স্বরলিপির অকৃত্রিম প্রমাণের জন্য গ্রামোফোনের আদি রেকর্ডগুলোর লেবেলে লেখা নম্বর, শিল্পীর নাম, নজরুলের কিছু কিছু গান অন্য সুরকারেরাও করেছিলেন, সে ক্ষেত্রে তাঁদের নাম এবং গ্রামোফোন কোম্পানির নামও উল্লেখ করা হয়েছিল তাতে।’ শুদ্ধ স্বরলিপি প্রকাশের পরপরই ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় চারপাশে। একদল বলল, না, এটা ভুয়া! আরেক দল বলল, হ্যাঁ, এটাই ঠিক। যুক্তিসংগত কারণেই দ্বিতীয় পক্ষের দলটাই ভারী ছিল তখন। তবে সুধীন দাশের এত যে ভালোবাসা, এত পরিশ্রম, তার কিন্তু যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়নি তখন! নজরুল সুরলিপির প্রচ্ছদ, প্রিন্টার্স লাইন, এমনকি ভূমিকাতেও স্বরলিপিকার হিসেবে ছাপা হয়নি তাঁর নাম! কর্মকর্তাদের যুক্তি—এটা তো একটা সম্মিলিত প্রকল্প, এতে কেন শুধু আপনার নাম থাকবে? ভবিষ্যতে এ কাজ অন্যরাও করবেন। তাঁরা শুধু বইয়ের এক জায়গায় ‘স্বরলেখক’ হিসেবে সুধীন দাশকে পরিচয় করিয়ে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করলেন! তাই পাঁচ খণ্ডের কাজ করে সরে আসেন তিনি। কেটে যায় সময়। এর মাঝে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থাপিত হয় নজরুল ইনস্টিটিউট। সেখান থেকে সুধীন দাশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। স্বরলিপি তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয় তাঁকে। স্বভাবতই, চোখ বুজে প্রস্তাবটি লুফে নেন তিনি। মূল গানের সঙ্গে স্বরলিপির স্বচ্ছতার জন্য অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি যাচাই কমিটি গঠন করে নজরুল ইনস্টিটিউট। এরপর আবারও শুরু হয় পথচলা। এ পর্যন্ত ৩৩ খণ্ড নজরুল সুরলিপি বেরিয়েছে সেখান থেকে। আর ৩৩টির মধ্যে ২০টির প্রচ্ছদে স্বরলিপিকারের নামের জায়গায় সুধীন দাশ নামটি লেখা হয়েছে যত্নের সঙ্গে। শুধু স্বরলিপি করেই ক্ষান্ত থাকেননি তিনি। নজরুল ইনস্টিটিউটে সংরক্ষিত আদি গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে সিডি তৈরির ব্যাপারেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। ‘আমি গানের ভুবনের মানুষ, সব ধরনের গানের প্রতিই আমার প্রাণের টান। তাই রবীন্দ্র, নজরুল, পল্লিগীতি, লোকগীতি থেকে শুরু করে সব ধরনের গান শিখতে চেয়েছি আমি। আর নজরুলের গানের স্বরলিপি করার সময় দেখি, লালনের গানেরও একই হাল। তাই তাঁর কিছু গানের স্বরলিপি করে বই আকারে প্রকাশ করেছি সেই টান থেকেই।’

নিশি ভোর হলো
৩৩ খণ্ড নজরুল সুরলিপির মধ্যে কণ্ঠশিল্পী নীলিমা দাশেরও নাম জড়িয়ে আছে একজন স্বরলিপিকার হিসেবে। তিনি ছিলেন সুধীন দাশের বড় ভাই সুরেন দাশের ছাত্রী। সেই সূত্রেই পরিচয় এবং ১৯৫৫ সালে তাঁর সঙ্গেই পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন সুধীন দাশ। ‘নীলিমা এখন খানিকটা অসুস্থ। সে এখনো গান নিয়েই আছে। গান গায়, শেখায়।’ বাসায় আর কে কে থাকেন? বাঁয়ের চোখটা পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে, ডানেরটাও ভালো নেই, পানি পড়ে সারাক্ষণ। চশমা খুলে পানি মুছতে মুছতে জানালার বাইরের জমাটবাঁধা অন্ধকারে তাকান সুধীন দাশ। বলেন, ‘বাসায় এখন আমি আর আমার স্ত্রী; তবে ছেলে মারা যাওয়ার পর মেয়েটা আমাদের সঙ্গেই থাকে। ওপরের তলায়।’ ছেলের স্মৃতিচারণা করেন তিনি, ‘খুব ভালো গিটার বাজাত নিলয়। গান শিখেছিল আমার কাছেই। নিজেই লিখত, সুর করত। একটা অ্যালবামও বেরিয়েছিল। ২০০৬ সালে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেল ছেলেটা।’ এরপর খানিকক্ষণের নীরবতা। একসময় নীরবতা ভেঙে মেয়ের কথাও বলেন, ‘মেয়ে সুপর্ণা দাশ। রবীন্দ্রসংগীতই গায় ও। ওর দুই ছেলেমেয়ে। একজন হলো সেই দস্যি, মানে দীপ আর আরেকজনের নাম ঐশী।’ এখনো, এই বয়সে ভোর চারটার দিকে ঘুম থেকে জাগেন সুধীন দাশ। উঠেই মিরপুরের বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন বোটানিক্যাল গার্ডেনের উদ্দেশে। দিব্যি চার-পাঁচ মাইল হেঁটে আসেন একা একা! এরপর পত্রিকা পড়ে, ক্রিকেট খেলা দেখে, নয়তো নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খুনসুটি করে কাটিয়ে দেন অবসর সময়গুলো। যদিও বেশির ভাগ সময়ই অবসর তাঁর কাছে অধরাই থেকে যায়। একসময় প্রচুর মাছ ধরেছেন। বলছিলেন, ‘ঘোর নেশা বলতে যা বোঝায়! সারা দিন হয়তো স্বরলিপি আর গান নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, ওদিকে সারাটা রাত দিয়ে দিতাম ধানমন্ডির লেকের মাছের পেছনে। হাতে ছিপ, পাশে হারিকেন। সঙ্গী-সাথিদের নিয়ে বসে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর মাছেরাও হতাশ করত না তখন। বললে গল্প মনে হবে, কিন্তু সেই সময় ধানমন্ডি লেক থেকে ৩৬-৩৭ কেজি ওজনের মাছও ধরেছি আমি।’

তবে, এখন সেই সময়ও নেই, সামর্থ্যেও যথেষ্ট টান পড়েছে। বাসায় ছাত্ররা আসে। নজরুল ইনস্টিটিউটে সময় দিতে হয়। তারপরও থেমে নেই পথচলা। যেন আপনমনেই বলছিলেন, ‘নজরুলের স্বরলিপির কাজটা তো আমার জীবনের একটা অবশ্যপালনীয় কর্তব্য বলে মানি। ভেবে অবাক হই, মাত্র ২০-২২ বছরের ক্ষুদ্র সক্রিয় জীবনে তিন হাজারের মতো গান লিখেছিলেন নজরুল! পাশাপাশি কবিতা, নাটক, অনুবাদ, কথাসাহিত্য তো ছিলই! আমার বিশ্বাস, এমন ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। আর তাঁর এই সৃষ্টির সাগরে সাঁতরাতে চেষ্টা করেই আমি ধন্য! এখানেই আমার ভালো লাগা।’