Thank you for trying Sticky AMP!!

সৌদিতে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যা দুই দেশেরই

কিছু বেসরকারি সংস্থার মতে, চলতি বছর সৌদি থেকে ফিরে আসা বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা ১৮ হাজারের বেশি। ইউএনবি ফাইল ছবি

সৌদি আরবে গিয়ে নানা কারণে অবৈধ হয়ে পড়া বাংলাদেশের কর্মীরা প্রায় প্রতিদিনই দেশে ফিরছেন। গতকাল সোমবারও ফিরেছেন ৬১ জন। এ নিয়ে ১ থেকে ৪ নভেম্বর (গতকাল সোমবার) পর্যন্ত ৩৯৩ জন দেশে ফিরলেন। এ ছাড়া নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশের নারী কর্মীদের ফেরার প্রবণতাও অব্যাহত আছে।

পররাষ্ট্র এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সৌদি আরবে নারী ও পুরুষ কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে দুই দেশেরই বেশ কিছু সমস্যা আছে। নারী কর্মীরা সেখানে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আবার পরিবর্তিত পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারছেন না। এসব নারী কর্মী শেষ পর্যন্ত কোথায়, কীভাবে আছেন, বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষে সেটার দেখভাল করাও সম্ভব হচ্ছে না।

পুরুষ কর্মীদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ইকামা (কাজের অনুমতিপত্র) নিয়ে গেলেও একটি বড় অংশ ফ্রি ভিসায় গিয়ে বিপদে পড়ছে। এরা মূলত ইকামার মেয়াদ শেষ হওয়া আর কফিল (নিয়োগকর্তা) পরিবর্তনের কারণে আটক হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেছেন, সৌদি আরবে নিয়োগের প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে স্বচ্ছতা নেই। সে দেশে যাওয়ার পর কর্মীদের ব্যাপারে কোনো দায় নেয় না সে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার নারী কর্মীদের ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় বাংলাদেশে যে সমস্যাগুলো আছে, নিরাপদ অভিবাসনের স্বার্থে সেগুলো দূর করার ওপর জোর দেওয়া উচিত।

সৌদি আরবে বাংলাদেশের কর্মীদের ক্ষেত্রে সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের কর্মী বিশেষ করে নারী কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়ায় কিছু সমস্যা আছে। এ জন্য সেখানকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার স্বার্থে প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়া ও সময়সূচিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। কর্মীরা যাতে সেখানে গিয়ে সুরক্ষা পান, সে বিষয়েও জোর দেওয়া হচ্ছে।

পুরুষ কর্মীদের ফিরে আসার বিষয়ে ইমরান আহমেদ বলেন, সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশের কর্মীরা কেন ফিরছেন, তা তদন্ত করা হচ্ছে। অনিয়মের ব্যাপারে প্রমাণ পাওয়া গেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঢাকায় একটি সরকারি সূত্র গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে জানিয়েছে, প্রায় প্রতি মাসে সৌদি আরব থেকে গড়ে এক হাজারের বেশি কর্মী দেশে ফিরছেন। গত জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ফিরে আসা কর্মীর সংখ্যা ১৩ হাজার ৭০০। তবে কিছু বেসরকারি সংস্থার মতে, এই সংখ্যা ১৮ হাজারের বেশি। এঁদের ৯০ শতাংশ পুরুষ কর্মী।

মূলত জনশক্তি রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে বাংলাদেশের কর্মীরা সৌদি আরবে যান। সৌদি আরব থেকে কর্মীদের চাহিদা পাওয়ার পর তাতে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং ঢাকায় জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অনুমোদন নেওয়া হয়। এরপর বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা সৌদিগামী কর্মীদের সে দেশে পাঠিয়ে থাকেন।

রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ অন্তত সাতটি দেশের ১০ লাখ বিদেশি কর্মীকে তাঁদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এঁদের মধ্যে বাংলাদেশের কর্মীর সংখ্যা অন্তত ১ লাখ। সৌদি কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি বাংলাদেশকে এ পরিসংখ্যানের তথ্য দিয়েছে। অবশ্য একই সময়ে বাংলাদেশের অন্তত ১২ লাখের বেশি কর্মী সৌদি আরবে গেছেন।

পাঁচ বছরে ১২ লাখ
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১২ লাখ ৭৮ হাজার ৯২০ কর্মী সৌদি আরবে গেছেন। এঁদের মধ্যে নারী কর্মীর সংখ্যা ২ লাখ ৯৩ হাজার ৫৮৮।

>

সৌদিতে নিয়োগের প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে স্বচ্ছতা নেই।
বাংলাদেশ দূতাবাসও ঠিকমতো দেখভাল করে না।
প্রায় প্রতি মাসে সৌদি থেকে গড়ে ১ হাজারের বেশি কর্মী দেশে ফিরছেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ৯ হাজার ১৭৭ জন নারী কর্মীকে সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়। এঁদের মধ্যে দেশে ফেরত পাঠানো হয় ৮ হাজার ৬৩৭ জনকে। এ বছরের প্রথম ১০ মাসে রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের আশ্রয়কেন্দ্রে ১ হাজার ২০৬ জন নারী কর্মীকে রাখা হয়। এঁদের মধ্যে ৯৩ জন অসুস্থ ছিলেন। আর আশ্রয়কেন্দ্রে আসার সময় গর্ভবতী ছিলেন অন্তত ১৬ জন। পরে ৭৮৭ জনকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

মনোযোগ বাজার আর সংখ্যায়
সৌদি আরবের কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সৌদি আরবে বাংলাদেশের কর্মী পাঠানো কার্যত বন্ধ ছিল। এরপর ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর মধ্য দিয়ে বাজার চালু হয়। নারী গৃহকর্মী পাঠানোর শুরু থেকেই সৌদি আরব বলে এসেছে, বিদেশে কাজ করার মতো শারীরিক ও মানসিকভাবে সামর্থ্য থাকার পাশাপাশি সে দেশের ভাষা, রীতিনীতি ও জীবনাচার সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা থাকতে হবে। অথচ কখনোই এ বিষয়গুলোতে জোর দেওয়া হয়নি। প্রশিক্ষণের নামে যেনতেনভাবে লোক পাঠানো হয়।

বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা বলছেন, এখন পর্যন্ত নারী-পুরুষ মিলিয়ে সৌদি আরবে পাঠানো কর্মীদের ৯৫ শতাংশই অদক্ষ। কর্মীর গুণগত মান বাড়ানোর ব্যাপারে সরকার তেমন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অথচ সৌদি আরব বারবার বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠানোর বিষয়টিতে জবাবদিহি ও শৃঙ্খলা আনার পাশাপাশি কর্মীর গুণগত মান বাড়ানোর কথা বলছে। আবার সৌদি আরবে পুরুষ কর্মী পাঠানোর খরচও অন্য দেশের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা এই প্রতিবেদককে বলছেন, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ফিলিপাইনের তুলনায় তিন গুণ বেশি খরচ করে বাংলাদেশের কর্মীরা সৌদি আরবে কাজের জন্য যান। একেকজন কর্মী ৩ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ করে সেখানে যান। অথচ প্রতি মাসে সৌদি মুদ্রায় গড়ে ৬০০ থেকে ৮০০ রিয়াল (১২ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা) আয় করেন। বিপুল টাকা খরচ করে বিদেশে এসে টাকা তুলতে তাঁরা হিমশিম খান।

সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশের কর্মীদের দেশে ফিরে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার মহাসচিব নোমান আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বৈধ কাগজপত্র না থাকা, এক প্রতিষ্ঠানে কাজের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করা এবং নির্ধারিত কাজের বাইরে বাড়তি উপার্জনের সঙ্গে যুক্ততা—এসব কারণে সৌদি কর্তৃপক্ষ বিদেশি শ্রমিকদের আটক করে। তবে বাংলাদেশের কর্মীদের ঠিক কী কারণে ফেরত পাঠানো হচ্ছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশি যেসব কর্মী যাচ্ছেন, তাঁদের ব্যাপারে তথ্য থাকলেও এখন পর্যন্ত কত কর্মী ফিরে আসছেন, সে ব্যাপারে কোনো তথ্যভান্ডার নেই।

অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন তাসনীম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সৌদি আরবে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে দুই দেশেই সমস্যা আছে। সৌদি আরবের সমস্যাগুলো নিয়ে আমাদের তেমন কিছু করার নেই। কিন্তু নিরাপদ অভিবাসনের স্বার্থে বাংলাদেশের দিক থেকে যেসব সমস্যা আছে, সেগুলো দূর করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।’

তাসনীম সিদ্দিকীর মতে, সৌদি আরবে গিয়ে বাংলাদেশের নারী কর্মীরা যে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তার বড় অংশটা হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তাই বাংলাদেশ থেকে নারী কর্মী পাঠালে তাঁরা যেন সৌদি আরবের শহর এলাকায় যান, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি নারী কর্মীরা কেমন আছেন, তা দূতাবাসের প্রতিনিধিরা প্রতি মাসে অন্তত একবার খোঁজ নেবেন।