Thank you for trying Sticky AMP!!

স্কাউটিংয়ে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়ে প্রশংসায় ভাসছে দেবীগঞ্জের নিশাত আনান

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের কলেজপাড়ার স্কাউট নিশাত আনান রাষ্ট্রপতি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। ছবি: লেখক

রাষ্ট্রপতি অ্যাওয়ার্ড অর্জন সহজ নয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তা অর্জন করতে হয়। লাখো সদস্যদের মধ্য থেকে হাজারো শিক্ষার্থী সেটি পাওয়ার চেষ্টা করে উপজেলা পর্যায়েই। সোনার সেই হরিণ কজনই বা অর্জন করতে পারে। বছরে বাংলাদেশ স্কাউটস তিনটি রেঞ্জে এ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে থাকে যার প্রাথমিক পর্যায়কে বলা হয় ‘শাপলা কাব অ্যাওয়ার্ড’; মাধ্যমিককে ‘প্রেসিডেন্ট স্কাউট অ্যাওয়ার্ড’ (পিএস) এবং কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে ‘প্রেসিডেন্ট রোভার স্কাউট অ্যাওয়ার্ড’ (পিআরএস)।

কাব স্কাউট, স্কাউট, রোভার স্কাউট—এ তিনটি স্কাউটিংয়ের পর্যায়। স্কাউটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিদ্যুৎ ক্যাম্প, আঞ্চলিক সমাবেশসহ জেলার বিভিন্ন প্রান্তের ক্যাম্পে অংশ নিয়ে এক ছাত্রী অর্জন করেছে স্কাউটদের জন্য বাংলাদেশ স্কাউটের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘প্রেসিডেন্ট স্কাউট অ্যাওয়ার্ড’। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্কাউট প্রোগ্রাম যথাযথভাবে বাস্তবায়ন ও সম্পন্ন করার সম্মাননাস্বরূপ এই স্বীকৃতি। গত ২০ জানুয়ারি জাতীয় স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মৌচাক, গাজীপুরে নবম জাতীয় কাব ক্যাম্পুরি অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি ও চিফ স্কাউট মো. আবদুল হামিদ তার হাতে অ্যাওয়ার্ড তুলে দেন।

এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম সে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ পৌর শহরের কলেজপাড়ার স্কাউট নিশাত আনান কাকলি। সে শহরের পারফেক্ট একাডেমি থেকে প্রাথমিক পাঠ সম্পন্ন করে দেবীগঞ্জ অলদিনী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে। ওই প্রতিষ্ঠানের স্কাউট দলের হয়ে সে রাষ্ট্রপতি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে।

স্কাউটিংয়ে সম্পৃক্ততা ও অর্জন সম্পর্কে নিশাত আনান বলে, ‘আমার বয়স যখন ৩ মাস, আমার বাবা তখন আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। ছোট থেকেই মায়ের স্নেহ-ভালোবাসায় বড় হয়েছি। আমার বাবা যে নেই, এ কথা মা আমাকে কখনো বুঝতে দেননি। মা সব সময় ছাতার মতো আমাকে আগলে রেখেছেন। একমাত্র সন্তান হওয়ায় আমি যখন যা কিছু করতে চেয়েছি বা যা কিছু চেয়েছি, মা আমার সে দাবি অপূর্ণ রাখেননি। এরপর আমি স্কুলে লেখাপড়া করতে করতে দেখি, অন্য ছাত্রছাত্রীরা স্কাউট, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের দেখে আমারও আশা জাগে, আমিও যদি নেতৃত্ব দিতে পারতাম তাহলে নিজকে খুব ভালো লাগত। এ কথা আমি প্রথমে আমি আমার মাকে জানাই। মা প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তী সময়ে আগ্রহ ও ইচ্ছাশক্তি দেখে আর বাধা দেননি। এরপর আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি, তখন স্কাউট লিডার ফজলুল হক স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনি আমার আগ্রহ দেখে আমাকে স্কাউটের বিভিন্ন দীক্ষা দিয়ে আমাকে সহায়তা করতে থাকেন। এরপর ধীরে ধীরে আমি স্কাউট সম্পর্কে নানান রকম জ্ঞান অর্জন ও চর্চা শুরু করি।’

নিশাত আনান বলে, ‘এর পর থেকে স্কাউট বিষয়ে আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। স্কাউট থেকে একের পর এক সাফল্য আসতে থাকে। এসব দেখে আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ অন্য শিক্ষকেরাও আমাকে বিভিন্ন পর্যায়ে স্কাউটে অংশগ্রহণ করতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এরপর আমি জাতীয় পর্যায়ে স্কাউটে অংশগ্রহণ করি। সেখান থেকে আমি আমার জীবনের সেরা সাফল্য অর্জন করি। এটা এমন এক সাফল্য, যার কথা না বললেই নয়, সেটা হলো প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড। এটা আমি গত ২০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছ থেকে গ্রহণ করি। একজন মেয়ে হয়ে এমন সাফল্য অর্জন করতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি, আর সেই সঙ্গে আমি আমার মাসহ যাঁরা আমার এই সাফল্যের পেছনে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি।’

নিশাত আনানের মা বলেন, ‘কাকলির বাবা মারা যাওয়ার পর আমি তাকে অনেক আদরে মানুষ করেছি। কখনো বাবার অভাব বুঝতে দিইনি। ছোট থেকেই ও যা কিছু করতে চেয়েছে, আমি তা করতে দিয়েছি। আর স্কাউট বিষয়ে প্রথমে আমার মত না থাকলেও ওর আগ্রহ আর ইচ্ছাশক্তি দেখে আমি তাকে বাধা দিইনি। আমি তাকে সব সময় সাবধানে ও অন্যান্য স্কাউট সদস্যসহ শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ করে চলতে উৎসাহিত করেছি। যা-ই হোক, আমার মেয়ের এমন সাফল্যে আমি নিজেকে গর্বিত মনে করি। আর আমার মেয়ের এ সফলতার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।’

নিশাত আনানের রাষ্ট্রপতি অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পেছনে মায়ের একান্ত চেষ্টা ও শিক্ষকদের অবদান রয়েছে। ছবি: লেখক

নিশাত আনানের স্কাউট লিডার ফজলুল হক বলেন, ‘আমরা সবাইকে উৎসাহিত করি এ প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার জন্য। আমরা দেবীগঞ্জ অলদিনী থেকে ১৩ জনকে মোটামুটিভাবে উৎসাহিত করে ফরম পূরণ করাতে সক্ষম হই। পরে এদের মধ্যে সবাই পিছপা হলেও দুজন টিকে থাকে—তার মধ্যে কাকলি একজন। অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে পর্যায়ক্রমে জেলা, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের মাধ্যমে নিশাত আনান প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। আর এটাতে আমি একটা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মধ্যে দিয়ে ছিলাম, আসলে মানুষের ইচ্ছাশক্তির কাছে কোনো কিছু বড় না, মানুষ ইচ্ছে করলে সবকিছুই করতে পারে। আসলে আমারও একসময় আকাঙ্ক্ষা ছিল আমি প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড পাব। কিন্তু আমি অর্জন করতে পারিনি। আজ নিশাত আনান কাকলির এ অ্যাওয়ার্ড অর্জনের মধ্যে দিয়ে আমি পরিপূর্ণতা ফিরে পেয়েছি। আমি খুবই আনন্দিত।’

দেবীগঞ্জ অলদিনী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রদীপ কুমার সিংহ বলেন, ‘আমার স্কুলের মেয়ের এমন সাফল্যে আমি খুবেই আনন্দিত। তার এই সাফল্যের পেছনে আমি বা আমার স্কুল ক্রেডিট নিতে চাই না। সে মেধা ও পরিশ্রমের কারণে এ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে, আমরা স্কুল থেকে সার্বিকভাবে কিছু সহযোগিতা করছি মাত্র।’

নিশাত আনানের স্কাউট শিক্ষক আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘নিজেকে আজ বিজয়ী মনে হচ্ছে আমাদের দেবীগঞ্জ প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড পাওয়ায় এবং শাপলা অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার জন্য। এমনও সময় গেছে, আমি আশপাশের উপজেলার স্কাউট প্রশিক্ষকদের সহযোগিতা নিয়েছি। কাকলির স্কুল এবং স্কুলের শিক্ষক সার্বিকভাবে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে।’

প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে দেবীগঞ্জের নিশাত আনান ছাড়াও সারা দেশের ৪৭ শিক্ষার্থীকে ‘রাষ্ট্রপতির স্কাউট অ্যাওয়ার্ড’ এবং স্কাউটে অসামান্য অবদানের জন্য স্কাউট চিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থীকে ‘রাষ্ট্রপতি রোভার স্কাউট অ্যাওয়ার্ড’ তুলে দেন রাষ্ট্রপতি ও চিফ স্কাউট মোহাম্মদ আবদুল হামিদ।