Thank you for trying Sticky AMP!!

স্বাস্থ্য খাতের নেতৃত্বে থাকবে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

১৯৯৮ সালের ৩০ এপ্রিল জাতীয় সংসদে আইন পাসের মধ্য দিয়ে ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিকেল রিসার্চকে (আইপিজিএমআর) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) রূপান্তর করা হয়। একই বছর ২২ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টি কার্যক্রম শুরু করে। এটিই দেশের প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

বিএসএমএমইউয়ের জন্মলগ্নে এর কার্যকারিতা ও উপযোগিতা নিয়ে অনেকের মনেই নানা প্রশ্ন, সন্দেহ ছিল। কী করবে এই বিশ্ববিদ্যালয়, এর কাজের পরিধি কী হবে, মেডিকেল কলেজ বা বিশেষায়িত ইনস্টিটিউটের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী হবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এর পার্থক্য কোথায় হবে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা ছিল। প্রতিষ্ঠার ২৪ বছর পরও সেই অস্পষ্টতা এখনো পুরোপুরি দূর হয়নি। তবে দেশের স্বাস্থ্য খাতে প্রতিষ্ঠানটি স্বতন্ত্র অবস্থান করে নিয়েছে এবং দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিএসএমএমইউয়ের অভিজ্ঞতা থেকে সরকার দেশের সব বিভাগে একটি করে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলছে। জনস্বাস্থ্যবিদ ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাংলাদেশকে ভবিষ্যতের পথ দেখাবে।

বিএসএমএমইউয়ের অভিজ্ঞতা

১৯৭০ সালে নির্বাচনের আগে ২৮ অক্টোবর রেডিও ও টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তানে) দ্রুত মেডিকেল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি করেছিলেন। অনেকে মনে করেন, দেশে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বীজ বোনা ছিল ওই ভাষণে।
এর আগে ১৯৬৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজকে ঘিরে প্রতিষ্ঠিত হয় আইপিজিএমআর। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে পরিত্যক্ত শাহবাগ হোটেলে স্থানান্তরিত হয় আইপিজিএমআর। তখন এটি পিজি হাসপাতাল হিসেবে পরিচিতি পায়। বিশেষায়িত ও উন্নত চিকিৎসা সেবার জন্য পিজি হাসপাতাল খ্যাতি অর্জন করে।
গত শতকের আশির দশকে চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়ে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেছিল। তার মধ্যে একটি দাবি ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা।

বিএসএমএমইউয়ের উপাচার্য মো. শারফুদ্দিন আহমেদ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি অনুষদে শিক্ষকের সংখ্যা ৪৭৬। ৪৬টি পৃথক বিষয়ে ৯৬টি কোর্স চালু আছে। উচ্চশিক্ষার জন্য এসব কোর্সে প্রায় দুই হাজার চিকিৎসক ভর্তি হন। এর আছে ১ হাজার ৯০৪ শয্যার হাসপাতাল। এ হাসপাতালের বহির্বিভাগে দৈনিক গড়ে আট হাজার রোগী চিকিৎসা নেন। এখানে তুলনামূলক কম খরচে রোগ নির্ণয় করা যায়। গবেষণার জন্য বার্ষিক বরাদ্দ ১২ কোটি টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ে অটিস্টিক শিশুদের সেবা ও নারীদের ক্যানসার শনাক্তের মতো এমন কিছু বিশেষায়িত কর্মসূচি ও উদ্যোগ রয়েছে, যা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে নেই।

বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা এবং শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও উচ্চতর ডিগ্রি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিএসএমএমইউর যথেষ্ট সুনাম আছে। তবে অভিযোগ আছে, গবেষণায় পিছিয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিএসএমএমইউয়ের অভিজ্ঞতার পর সরকার ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। দুই বছর পর ২০১৮ সালে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। সর্বশেষ ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠা করে শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা। নতুন এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটি পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু করতে পারেনি। সরকারের ইচ্ছা বাকি তিনটি বিভাগেও একটি করে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। দেশে মোট আটটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হবে।

ভবিষ্যতের নেতৃত্ব

বিএসএমএমইউ প্রতিষ্ঠার সময় এর উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, ঠিক তেমনি একটি দেশে আটটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়েও অনেকের মনে প্রশ্ন আছে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসায় উন্নত অনেক দেশে একটিও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় নেই।

চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. ইসমাইল খান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কীভাবে গড়ে তোলা হবে, কতটা স্বাধীনতা দেওয়া হবে, সেটিই বড় চ্যালেঞ্জ। ঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার দিকনির্দেশনা দেবে।

বিশ্ববিদ্যালয়–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান কাজ হবে মূলত চারটি। প্রথমত, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজ নিজ এলাকার মেডিকেল কলেজগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম তদারক করবে। দ্বিতীয়ত, এমবিবিএস পাস চিকিৎসকদের স্নাতকোত্তর ডিগ্রির শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবে। বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে। তৃতীয়ত, জনস্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও রোগ নিয়ে মৌলিক ও দেশের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা করবে। চতুর্থত, বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে জটিল রোগের চিকিৎসা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালগুলো হবে রেফারেল হাসপাতাল। দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে যেসব জটিল ও নতুন রোগের চিকিৎসা সম্ভব নয়, সেসব রোগের চিকিৎসা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে।

অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতের বৈশ্বিক জ্ঞান আদান–প্রদানের কেন্দ্র হবে। বিএসএমএমইউ ইতিমধ্যে ভারতের অল ইন্ডিয়া মেডিকেল ইনস্টিটিউট, যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রকফেলার ফাউন্ডেশন, সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, থাইল্যান্ডের মোহিদাল ইউনির্ভাসিটির সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণার কাজ করেছে বা করছে। এ ছাড়া সুইডেন, জাপান, তুরস্ক, নেপাল ও ভুটানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারত্বে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ করছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় একই কাজ করবে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে বিশ্বের নামকরা গবেষক ও চিকিৎসকদের এদেশে আসার সুযোগ বাড়বে। এসব সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য গবেষকদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করার সুযোগ বাড়বে।

এসবের বাইরে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সহায়তা করতে পারবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে। মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন নীতি দলিল বা কৌশলপত্র তৈরি করে সাধারণত পরামর্শক সংস্থা বা দাতা সংস্থা। ভবিষ্যতে এই কাজগুলো করবে দেশের মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে প্রমাণভিত্তিক কর্মসূচি হাতে নিতে সহায়তা করবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা। ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য খাতের শিক্ষা, গবেষণা, সেবা ও নীতি প্রণয়নের নেতৃত্বে থাকবে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শেষ।