Thank you for trying Sticky AMP!!

হাঁটার গতিতে চলে বাস, ব্যবসায় মন্দা

মেট্রোরেল নির্মাণের কারণে যাতায়াতে ভোগান্তির শেষ নেই। হাঁটার গতিতে চলে বাস। কোথাও কোথাও হাঁটার গতির কাছেও যেন হার মানে। চওড়া সড়কের প্রায় অর্ধেকটাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাস বা রিকশা—সবই চলে একটি লেনে। রাস্তাও এবড়োখেবড়ো, ভাঙাচোরা। সরকারি একটি জরিপ বলছে, মেট্রোরেল নির্মাণের কারণে ১৫ মিনিটে এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে বাসসহ বিভিন্ন ধরনের গণপরিবহন। এতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় কাটাতে হয় যাত্রীদের। এই বর্ষা মৌসুমে ভোগান্তি আরও বেড়েছে।

মিরপুর এলাকায় সরেজমিন গিয়েও যাত্রীদের ভোগান্তির এই চিত্র পাওয়া গেছে। উত্তরা থেকে মিরপুর, ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের কাজ চলছে পুরোদমে। মেট্রোরেলের নির্মাণের কারণে মূল সড়কের আশপাশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে মিরপুর এলাকায় অনেক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, বেশির ভাগের আয় কমেছে।

চলমান মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সর্বশেষ অগ্রগতির পাশাপাশি একটি জরিপও করা হয়েছে। জরিপে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকায় নাগরিকদের কী ধরনের অসুবিধা হচ্ছে, তা তুলে ধরা হয়েছে। মেট্রোরেলের সুবিধা নিয়েও জানতে চাওয়া হয়েছে।

বৃহৎ প্রকল্প বিশেষজ্ঞ এম ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, নির্মাণকাজ চলার সময় গাড়ি চলতে কষ্ট হওয়া এবং ব্যবসায় মন্দাভাব—এসব উন্নয়নের মাশুল। ওই এলাকার পরিবহনব্যবস্থা কার্যকরভাবে সচল রাখার বিষয়টিতে প্রকল্প শুরু হওয়ার আগেই মনোযোগী হওয়া উচিত ছিল। তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের জরুরি ভিত্তিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।

আইএমইডির জরিপ
যেসব এলাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ করা হচ্ছে, সেসব এলাকার ২৬০ জন নারী-পুরুষের ওপর ওই মতামত জরিপ পরিচালনা করেছে সরকারি সংস্থা আইএমইডি। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, ওই এলাকার যাত্রীদের বাসে প্রতি এক কিলোমিটার যেতে গড়ে ১৫ মিনিট সময় লাগে। সেই হিসাবে, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে মতিঝিলের দূরত্ব প্রায় ১১ কিলোমিটার। এই পথ পাড়ি দিতে মিরপুরবাসীকে প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টা বাসে কাটাতে হয়।

উত্তরদাতাদের ৮১ শতাংশ মিরপুর, আগারগাঁও, পল্লবীসহ মেট্রোরেলের আশপাশের এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন না। কিন্তু ভবিষ্যতে যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হবে, এই আশায় ভোগান্তি সহ্য করে তাঁরা ওই এলাকায় ভাড়া থাকেন। জরিপ অনুযায়ী, ৯৪ শতাংশের মেট্রোরেল সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই।

মেট্রোরেল পরিচালনা করবে সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। ওই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাবেক যোগাযোগ সচিব এম এ এন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেট্রোরেল নির্মাণাধীন এলাকায় ব্যবসা মন্দা যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা ফুটপাত ভেঙে দুইটি গাড়ি পাশাপাশি চলতে পারে, সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছি।’

ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন অনেকে
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেট্রোরেল নির্মাণ এলাকায় ৬৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের আয় কমেছে। মিরপুর এলাকায় সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, বাস্তবচিত্র আরও কঠিন। ব্যবসায়ীদের হাহাকার চলছে। লোকসানের মুখে বহু ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার চিন্তা করছেন। মেট্রোরেল নির্মাণকাজ চলমান থাকায় ক্রেতা মিলছে না। সড়কের এপারের ক্রেতারা ওপারের দোকানে যেতে পারছেন না। আবার গাড়ি পার্কিং সুযোগ না থাকায় অনেকেই কেনাকাটা করতে ওই এলাকায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। বিক্রিবাট্টা অর্ধেকে নেমে গেছে বলে জানান বিক্রেতারা।

>উত্তরা থেকে মিরপুর হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ চলছে
নির্মাণকাজের জন্য সড়ক সরু হয়ে গেছে, ব্যবসা বন্ধ করেছেন অনেকে
মেট্রোরেল নির্মাণ এলাকায় ৬৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের আয় কমেছে
যাত্রীদের বাসে প্রতি এক কিলোমিটার যেতে গড়ে ১৫ মিনিট সময় লাগে

মিরপুর গোলচত্বর এলাকায় সিটি করপোরেশনের কার্যালয়ের পাশে টাচ অ্যান্ড ফ্যাশনের সামনে প্রতিষ্ঠান বিক্রির নোটিশ ঝোলানো আছে। ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক মহব্বত হোসেন জানান, বেলা দুইটা পর্যন্ত কোনো বেচাকেনা হয়নি। ক্রেতা টানতে পোশাকের মূল্যে ৩০ শতাংশ ছাড় দিয়েও ক্রেতা মিলছে না। তিনি জানান, আগে দিনে ৮-১০ হাজার টাকার বিক্রি হতো। এখন তা কমে ৩-৪ হাজার টাকায় নেমে এসেছে।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, সেনপাড়া, মনিপুর এলাকার টাইলস, স্যানিটারি পণ্য, আসবাবের ব্যবসায়ীরা। গাড়ি পার্কিংয়ের সুযোগ না থাকায় এখানে ক্রেতা মিলছে না। সড়কের এপারের ক্রেতা ওপারে যেতে পারছেন না। বেশ কিছু টাইলসের দোকান ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।

পরিকল্পনামতো কাজ এগোচ্ছে না
ঢাকার যানজট কমাতে এবং যাত্রীদের দ্রুত চলাচলের জন্য প্রায় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার মেট্রোরেল প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এতে জাপান দিচ্ছে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালের মধ্যে উত্তরা থেকে মিরপুর হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণ হবে। এর মধ্যে ২০২০ সালের মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ট্রেন চলাচল চালু করার কথা। কিন্তু আইএমইডি বলছে, এই সময়ের মধ্যে মেট্রোরেল চালু করা চ্যালেঞ্জিং হবে।

২০১২ সালে নেওয়া এই প্রকল্পের প্রথম সাত বছরে, অর্থাৎ গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত ২৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। খরচ হয়েছে ৬ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। অথচ এই সময়ে সাড়ে ৪৬ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একযোগে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চালু হবে। প্রথমে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালু করার পরিকল্পনা থেকে সরে আসে সরকার। তবে এই ডিসেম্বর মাসের পরে আগারগাঁও পর্যন্ত ভৌত কাজ শেষ। আর ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে মতিঝিল পর্যন্ত কাজ শেষ হবে। এরপর কমপক্ষে এক হাজারবার পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চলাচলের পর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করবে দেশের প্রথম মেট্রোরেল।