হাজার বছর আগের পরিকল্পিত জনপদ
প্রাচীন বিক্রমপুর (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ জেলা) ছিল বৌদ্ধবিহার ও মন্দিরের সমন্বয়ে গড়া এক পরিকল্পিত জনপদ। বিক্রমপুর অঞ্চলে চলমান প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণায় এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত স্থাপনা ও তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে গবেষকেরা এমনটাই ধারণা করছেন।
গত বছর এই অঞ্চলে প্রাক-মধ্যযুগীয় বৌদ্ধবিহার ও পঞ্চস্তূপ আবিষ্কারের পর এবার সন্ধান মিলল একটি বৌদ্ধমন্দির, অষ্টকোনাকৃতির স্তূপ ও ইটের নালার। খননে মাটির তলা থেকে যেসব স্থাপনা বেরিয়ে আসছে, তাতে একটি আধুনিক ও পরিকল্পিত জনপদের চিত্রই গবেষকদের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। এটি প্রায় ১১ শ বছর আগের। এই জনপদ ছিল বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারক ও পণ্ডিত শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থান।
আধুনিক যুগে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন রূপ হলো বৌদ্ধবিহার, যেখানে ধর্মশাস্ত্রের পাশাপাশি জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা করা হতো। আর স্তূপ হলো বৌদ্ধদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বিশেষ স্থান।
গতকাল শুক্রবার সকালে প্রাচীন এই বৌদ্ধমন্দিরের পাশে দাঁড়িয়েই এই আবিষ্কারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তিনি বলেন, এই প্রত্নস্থানে এ পর্যন্ত যে কয়টি স্থাপনা ও স্থাপনাংশ আবিষ্কৃত হয়েছে, তা দেশের ইতিহাসে এক নতুন সংযোজন। সরকারিভাবে এগুলো সংরক্ষণ করার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা চলছে।
আবিষ্কারের কথা জানাতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে মুন্সিগঞ্জের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন’। সংগঠনটির উদ্যোগে ও ব্যবস্থাপনায় চার বছর ধরে এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণার কাজ করছে ঐতিহ্য অন্বেষণ। গবেষণা প্রকল্পের পরিচালক অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের সভাপতি নূহ-উল-আলম লেনিন, খনন ও গবেষণাকাজের তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। খনন ও গবেষণার সঙ্গে রয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
সুফি মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, একসময় চন্দ্র-বর্মণ-সেন রাজবংশের রাজধানী প্রাচীন বিক্রমপুরের সব প্রত্ননির্দশন যে পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে যায়নি, এই আবিষ্কারে সেটিই যেন মূর্ত হয়ে উঠছে।
গবেষকেরা জানান, মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার নাটেশ্বরের একটি সুউচ্চ ঢিবির চারটি জায়গায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চালানো হলে সেখানে খ্রিষ্টীয় অষ্টম বা নবম শতকে নির্মিত এই বৌদ্ধমন্দিরের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রায় ১০০ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত মন্দিরটির বেশির ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলেও পশ্চিম-দক্ষিণ কোনার প্রায় পৌনে দুই মিটার প্রশস্ত দেয়াল অক্ষত রয়েছে। প্রায় আড়াই মিটার উঁচু দেয়ালের ভিত্তিমূলে ব্যবহার করা হয়েছে ‘ঝামা ইট’, যা ভবনকে আর্দ্রতায় দুর্বল হওয়া থেকে সুরক্ষা দিত। দেয়ালের বাইরে হাতে কাটা ইটের জালি নকশা ও অলংকরণ এবং বিভিন্ন আকৃতির ইটের স্থাপত্যশৈলী দেখে এটিকে মন্দিরের দেয়াল হিসেবে নিশ্চিত করা গেছে। ইটের বহুমাত্রিক ব্যবহার দেখে মনে হয়, প্রাচীন স্থপতিরা এই অঞ্চলে পাথরের অভাব ইট দিয়ে পূরণ করেছেন।
যে ঢিবির নিচে এই বৌদ্ধমন্দিরের সন্ধান মিলেছে, তার পাশেই পাওয়া গেছে এক বিশাল অষ্টকোনাকৃতির স্তূপ। এর একেকটি বাহুর দৈর্ঘ্য সাড়ে চার মিটার। গবেষকেরা মনে করছেন, মন্দির ও স্তূপের আশপাশেই আরেকটি বিহার রয়েছে। কারণ, এ পর্যন্ত যতগুলো বৌদ্ধবিহার আবিষ্কৃত হয়েছে, প্রতিটির ভেতরে বা বাইরে বৌদ্ধমন্দির ও স্তূপ পাওয়া গেছে। ঢিবির পশ্চিমে ও পূর্বে আরও দুটি স্বতন্ত্র স্থাপত্যের সন্ধান পাওয়া গেছে। পশ্চিমের স্থাপনাটি সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া না গেলেও এটিকে আরেকটি স্বতন্ত্র মন্দিরের অংশ বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর পূর্বদিকের স্থাপনাটি ইটের তৈরি নালা, যা দেখে বোঝা যায়, এখানে একটি পরিকল্পিত নগর গড়ে তোলা হয়েছিল।
প্রাচীন বিক্রমপুর অঞ্চল একসময় ছিল সমতটের রাজধানী। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তাঁর লেখায় এই অঞ্চলে ৩০টি বৌদ্ধবিহারের কথা উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে আটটির সন্ধান পাওয়া গেছে। গবেষকদের মতে, ওই ৩০টি বিহারের অনেকগুলোই ছিল প্রাচীন বিক্রমপুরে।
আরও পড়ুন
-
সকাল ৯টার ট্রেন ছাড়েনি বেলা ২টায়ও, স্টেশনেই ঘুমিয়ে পড়েছেন ক্লান্ত মা-মেয়ে
-
বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকতে সাংবাদিকদের বাধা ব্যাংক লোপাটকারীদেরই উৎসাহিত করবে: নোয়াব সভাপতি
-
পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল ভারত
-
মোদির বিভাজনের রাজনীতির পেছনের কারিগর, যেভাবে উত্থান অমিত শাহর
-
ঝড়বৃষ্টি হতে পারে ৬ দিন ধরে, বলছে আবহাওয়া অফিস