Thank you for trying Sticky AMP!!

১৫ ‘সাহেবে’ জিম্মি দুবলারচর

মাছ ধরার লাইসেন্সের নিয়ন্ত্রণ প্রভাবশালীদের হাতে। অস্থায়ী ঘর-দোকান বরাদ্দের নামেও চাঁদাবাজি।

সুন্দরবন

সাত মাস জনমানবহীন সুন্দরবনের দুবলার চর শীতের শুরুতে হয়ে ওঠে প্রাণচঞ্চল। প্রায় ১০ হাজার মৎস্যজীবী কার্তিক থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত এখানে মাছ ধরেন। প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকার কাঁচা মাছ ও শুঁটকি বিক্রি করেন দুবলার চরের জেলেরা।

দুবলার চরে কারা মাছ ধরবেন, কোন ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করবেন, প্রতি কেজি চিংড়ি, লইট্টা ও ছুরি মাছের দাম কত হবে—সবই ঠিক করে দেন প্রভাবশালীরা। ১৫ ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করেন এই চর। জেলেরা যাঁদের ডাকেন ‘সাহেব’ বলে। এই সাহেবরাই জিম্মি করে রেখেছেন ৯৮৫ জন ‘জেলে মহাজন’সহ প্রায় ১০ হাজার মৎস্যজীবীকে।

নৌকা ও জালের মালিক জেলেরা। তবে ব্যবসা করেন দাদন বা সুদে টাকা নিয়ে। প্রতিকূল পরিবেশ সেখানে তাঁদের নিত্যসঙ্গী। পানি থেকে মাছ ধরে ডাঙায় আনার পর সব নিয়ন্ত্রণ চলে যায় স্থানীয় প্রভাবশালীদের হাতে। জেলেদের অভিযোগ, প্রকৃত জেলেরা বন বিভাগ থেকে মাছ ধরার লাইসেন্স বা অনুমতিপত্র পান না। লাইসেন্সের নিয়ন্ত্রণ থাকে প্রভাবশালীদের হাতে। তাই হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না জেলেদের।

বন বিভাগ ও মাছ ব্যবসায়ী সূত্রে জানা যায়, বন বিভাগ থেকে ১০ হাজার টাকা দিয়ে মাছ ধরার লাইসেন্স নিতে হয়। বছরে লাইসেন্স নবায়ন ফি ৭৫০ টাকা। এ বছর বন বিভাগ থেকে ১৫ ব্যবসায়ী মাছ ধরার অনুমতি পেয়েছেন। তাঁদের অধীনে ৯৮৫ জন জেলে মহাজন দুবলার চরে অস্থায়ী বসতি গড়ে মাছ ধরছেন।

দুবলার চর বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রহ্লাদ চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে। জেলেদের নামে লাইসেন্স দিলে তাঁরা এটার ব্যবস্থাপনা করতে পারবেন বলে মনে হয় না।’

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর মাছ ধরার অনুমতি পেয়েছেন কামাল উদ্দিন আহমেদ, আফিয়া বেগম, খান শাফিউল্লাহ, শেখ মইনুদ্দিন আহমেদ, আরিফ হোসেন, রেজাউল শেখ, এ বি এম মুস্তাকিন, ইদ্রিস আলী, হাকিম বিশ্বাস, জালাল উদ্দিন আহমেদ, সুলতান মাহমুদ, বেলায়েত সরদার, কামরুর নাহার, শাহানুর রহমান ও আসাদুর রহমান সরদার। তাঁরা সবাই স্থানীয় ও আশপাশের এলাকার মানুষ হিসেবে পরিচিত।

একাধিক জেলের অভিযোগ, ‘সব বিনিয়োগ আমাদের হলেও মাছ বিক্রির টাকার বড় অংশ চলে যায় ওই ১৫ ব্যক্তির পকেটে।’ বরুণ দে নামের এক জেলে মহাজন প্রথম আলোকে বলেন, ‘১২ লাখ টাকা দাদন নিয়ে এ বছর মাছ ধরা শুরু করেছি। পুরো মাছ ওই ব্যবসায়ীকে দিয়ে দিতে হবে। আমার সঙ্গে কাজ করছে ৮ জন শ্রমিক। সব খরচ বাদে আমার কী লাভ থাকবে, জানি না।’

৩৫ বছর ধরে সুন্দরবনে মাছ ধরেন খুলনার ডুমুরিয়ার জেলে নারায়ণ বিশ্বাস। একসময় তিনি দুবলার চরে মাছ ধরার শ্রমিকের কাজ করতেন। এখন তিনি জেলে মহাজন। একটি ট্রলার বা মাছ ধরার নৌকা, জাল ও ১০ জন শ্রমিক নিয়ে মাছ ধরছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অস্থায়ী একটি বসতির জন্য বন বিভাগকে ৪ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। প্রতিবছর এই ঘর বাবদ টাকা দিতে হয়। ১৫ সাহেবের লোকেরা জেলে মহাজনদের কাছ থেকে বন বিভাগের নামে এই টাকা সংগ্রহ করেন।

এ বছর দুবলার চরে অস্থায়ী ৯৬টি দোকান বরাদ্দ করেছে বন বিভাগ। আবুল বাশার নামের এক দোকানের মালিক প্রথম আলোকে বলেন, দোকানপ্রতি (আয়তন অনুসারে) ৩-৬ হাজার টাকা দিতে হয়। তবে দোকানপ্রতি অল্প কিছু টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করলেও জেলেদের অস্থায়ী বসতির জন্য কোনো টাকা নেওয়া হয় না বলে দাবি করেন বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রহ্লাদ চন্দ্র রায়।

১৫ সাহেবের একজন দুবলার চর ফিশিং ম্যান গ্রুপের সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ দাবি করেন, ‘জেলে মহাজনদের কাছ থেকে এ ধরনের কোনো টাকা আমাদের লোকজন তোলেন না।’

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দুবলার চরে বিক্রি থেকে ৩ কোটি ২২ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করেছে সরকার। প্রতি ১০০ কেজি মাছ বিক্রি করলে ৫০০ টাকা রাজস্ব আদায় হয়। সরকার রাজস্ব পেলেও অবহেলিত এখানকার মৎস্যজীবীরা। তাঁদের খাবারের জন্য নেই সুপেয় পানি। নেই চিকিৎসার ব্যবস্থা। তাই একটি নৌ অ্যাম্বুলেন্স, পাঁচ মাসের জন্য একটি অস্থায়ী চিকিৎসা ক্যাম্পের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।