Thank you for trying Sticky AMP!!

১৯৬ বছরের রহস্য

গোপাল পালের প্রসিদ্ধ মণ্ডার দোকান। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জগৎকিশোর সড়কে গত রোববার দুপুরে তোলা।

‘মণ্ডা-মিঠাই তেতো সেথা, ওষুধ লাগে ভালো,
অন্ধকারটা সাদা দেখায়, সাদা জিনিস কালো!’

কবি যোগীন্দ্রনাথ সরকারের লেখা ‘মজার দেশ’ কবিতার মতোই সবকিছু উল্টে গিয়ে পাল্টে গেলেই কেবল মণ্ডার স্বাদ তেতো লাগতে পারে। বাংলা কবিতা-গল্পে মিষ্টির সঙ্গে মণ্ডার কথা পড়েননি এমন মানুষ বিরল। আর মণ্ডা বললেই মনে আসে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার প্রসিদ্ধ মণ্ডা।

১৯৬ বছর ধরে একটি পরিবারের হাতেই তৈরি হয়ে আসছে মুক্তাগাছার এই মণ্ডা। ওই পরিবারের বাইরের আর কেউ ওই মণ্ডা প্রস্তুতের প্রণালি জানেন না বলে দাবি মুক্তাগাছার প্রসিদ্ধ মণ্ডার দোকানটির মালিকপক্ষের।

বর্তমান ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা পৌর শহরে গোপাল পালের প্রসিদ্ধ মণ্ডার দোকানটি ১৮২৪ সালে স্থাপিত হয়। তখন মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। গোপাল পালের মণ্ডা তাঁকে মুগ্ধ করে। এরপর জমিদারবাড়ির খাবারের তালিকায় জায়গা করে নেয় মণ্ডা। অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে উপহার হিসেবে পাঠাতে মণ্ডাকেই বেছে নিয়েছেন জমিদারেরা। জমিদার পরিবারটির মাধ্যমেই মণ্ডার দেশব্যাপী সুনাম ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা করা যায়।

গোপাল পাল মারা যান ১৯০৭ সালে। এরপর পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে এ মণ্ডা তৈরি করেন গোপাল পালের বংশধরেরা। এখন পর্যন্ত গোপাল পালের উত্তরসূরিরাই কেবল এই মণ্ডা তৈরি করে থাকেন। মণ্ডার ইতিহাস নিয়ে গোপাল পালের বংশধরদের বের করা পুস্তিকায় বলা হয়েছে, মণ্ডা এক প্রকারের সন্দেশ। শুধু ছানা ও চিনি দিয়ে এটি বানানো হয়। তবে স্বাদের রহস্যটা পাকের (রান্নার) মধ্যে লুকিয়ে আছে, যা বছরের পর বছর ধরে গোপন রাখা হয়েছে।

ওই মণ্ডা তৈরির কৌশল নিয়ে স্থানীয় মানুষের মধ্যেও রয়েছে অপার কৌতূহল। মণ্ডার দোকানের মালিকেরা নিজেদের দোকানের কর্মচারীদেরও মণ্ডা তৈরির স্থানে যেতে দেন না। কেবল রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন ব্যক্তির নিরাপত্তার স্বার্থে কয়েকবার এর ব্যত্যয় ঘটেছে।

মণ্ডার দোকানের ভেতরে।

মণ্ডার দোকানটির মালিকদের একজন বলেন, বিভিন্ন সময় দোকানে বসেই এই মণ্ডার স্বাদ নিয়েছেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানসহ অনেক জাতীয় ব্যক্তিত্ব। ময়মনসিংহ অঞ্চলে গেলে এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাঁদের তৈরি মণ্ডার স্বাদ নিতে চান। গত বছর একজন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির জন্য মণ্ডা বানানো হয়। তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার সামনেই তাঁদের মণ্ডা বানাতে হয়েছিল। নিরাপত্তার কারণে এ রকম আরও কয়েকবার মণ্ডার গোপনীয়তার ব্যত্যয় হয়েছে।

গত রোববার মুক্তাগাছার মণ্ডার দোকানে গিয়ে কথা হয় বর্তমান পাঁচজন মালিকের একজন শিশির পালের সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁদের পাঁচ ভাই বর্তমান মালিক। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন। তাঁরা আধুনিক শিক্ষা নিয়েও বংশানুক্রমে মণ্ডার ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু এরপরের প্রজন্মের সদস্যদের আর মণ্ডার ব্যবসায় আগ্রহ নেই। এর মধ্যেই কেউ পড়াশোনা শেষ করে চিকিৎসক বা ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে দিয়েছেন।

বিভিন্ন সময় দোকানে বসেই এই মণ্ডার স্বাদ নিয়েছেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানসহ অনেক জাতীয় ব্যক্তিত্ব। ময়মনসিংহ অঞ্চলে গেলে এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাঁদের তৈরি মণ্ডার স্বাদ নিতে চান।

মণ্ডার কৌশল গোপন রাখার ফলে ঐতিহ্যবাহী এ সুস্বাদু খাবার হারিয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা মুক্তাগাছার অনেক মানুষের। সে প্রসঙ্গে শিশির পাল বলেন, বিষয়টি নিয়ে তাঁদের মধ্যেও কিছুটা দুশ্চিন্তা রয়েছে। যে কারণে সারা দেশেই মুক্তাগাছার মণ্ডার দোকানের শাখা করার কথা ভাবছেন তাঁরা।

এখন অনেকেই মণ্ডার জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল আইডেনটিফিকেশন) স্বীকৃতির জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি তুলেছেন। ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে, ২০১৭ সালেই সে দেশের ব্যবসায়ী মহল থেকে মণ্ডার জিআই স্বীকৃতি নেওয়ার দাবি উঠেছে।