Thank you for trying Sticky AMP!!

১৯৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক বিচার হওয়া দরকার: মালেকা খান

রাজধানীর সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটিতে একক বক্তৃতা দেন সমাজকর্মী মালেকা খান। তাঁকে সংবর্ধনা দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সোসিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ। পাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান। হাটখোলা, ঢাকা, ৪ এপ্রিল। ছবি: হাসান রাজা

মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের নারীদের ওপর কতটা অমানবিক, বীভৎস নির্যাতন ও অত্যাচার করা হয়েছিল, সেসব ঘটনা বলছিলেন সমাজকর্মী মালেকা খান। তাঁর সামনে বসে থাকা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা ছলছল চোখে পিনপতন নীরবতায় শুনছিলেন সেসব কথা। এ সময় অনেককে চোখ মুছতে দেখা গেল। ৪৮ বছর আগের নৃশংস ঘটনার স্মৃতি আজও কাঁদিয়ে গেল শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।

আজ বৃহস্পতিবার সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির সোসিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় সমাজকর্মী মালেকা খানকে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক পারভীন হাসান, সোসিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক মালেকা বেগম ও বিভাগের শিক্ষার্থীরা এবং বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরা উপস্থিত ছিলেন। সমাজকর্মী মালেকা খানের একক বক্তৃতা শেষে তাঁকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে উত্তরীয় পরিয়ে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পারভীন হাসান। এ ছাড়া মালেকা খানকে একটি ক্রেস্ট উপহার দেন উপাচার্য।

মালেকা খান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্যালুট ও ধন্যবাদ জানান। কারণ, দীর্ঘ ২১ বছর ধরে তাঁরা চেয়েছিলেন ১৯৭১ সালে নির্যাতিত নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। যে কাজটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করেছেন। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত নারীদের বীরাঙ্গনা বলায় তিনি প্রতিবাদ করেন। কারণ বীরাঙ্গনা শব্দটির মানে হলো বীরের অঙ্গ ছিনিয়ে আনে যে, এমন অর্থে ব্যবহৃত একটি শব্দ। অথচ এ দেশে বীরাঙ্গনা শব্দের মানে করা হয়েছে ‘একাত্তরে নির্যাতিত নারী’। তিনি সব নির্যাতিত নারীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ডাকার আহ্বান জানান।

একক বক্তৃতায় সমাজকর্মী মালেকা খান বলেছেন, ‘আপনারা সবাই বলবেন, এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক বিচার হওয়া দরকার। এই প্রজন্মের কাছে আমাদের দাবি রয়ে গেল।’ তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রামের সব লোকজন আমাদের সাহায্য করেছে। কী করে বলি ওরা মুক্তিযোদ্ধা না? সে জন্য কোনো দিন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো সম্মান বা কোনো কিছু পাওয়ার জন্য এ কাজ করিনি। ওটার জন্য কখনো আমরা লালায়িত না। আমরা দেশটাকে ভালোবাসি।’

যুদ্ধে নিজের স্বজন হারানোর কথা বলে মালেকা খান বলেন, ‘যুদ্ধের সময় জানতে পারলাম কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগ দিয়েছিলেন আমার ভাই, তাঁর খবর পাচ্ছি না। আমার এক কাজিন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, তাঁরও খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। আমরা শহীদ পরিবারেরও সদস্য। ১৯৭২ সালের মে মাসে গণকবর খুঁড়ে তাঁদের দেহাবশেষ তোলা হয়েছিল। আমি খুব দুঃখ পেলাম, ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের কথা কেউ লেখেনি। কোনো পত্রিকায় আসেনি। আমি অনুরোধ করব তরুণ প্রজন্মকে, তোমরা ১৯৭১-কে জানতে শুরু করো। ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছে, তারা কারা? ২ লাখ নারী শহীদ হয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে, তারা কারা?’

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা উল্লেখ করে মালেকা খান বলেন, ‘১৯৭১-এ ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর যে ভাষণ, সেই ভাষণ থেকে দুটি লাইন নিয়ে আমি মালেকা বাকি জীবন চলছি। একটি হলো, “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো”। আরেকটি হলো, “তোমাদের যা কিছু আছে, তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো”।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তানিরা যেমন আমাদের শত্রু, তেমনি অশিক্ষা-কুশিক্ষা এগুলোও আমাদের সামাজিক শত্রু। আমরা যে যেখানে পারি, ভালো কাজ করব, এটা নিয়েই আমাদের পথচলা। আমি চেষ্টা করেছি ভালো কাজের সঙ্গে থাকতে। আমার যত দুর্বলতা বা অক্ষমতা আছে, সেগুলো আপনারা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।’

সমাজকর্মী মালেকা খান বলেন, ‘৭ মার্চের পর আমরা কী করতে পারি? বঙ্গবন্ধু বললেন, অফিসে গেলে কর্মীদের বেতন দিয়ে দেবেন, কেউ কোনো কাজ করবেন না। চলল অসহযোগ আন্দোলন। আমরা অসহযোগ আন্দোলনে গার্ল গাইড হিসেবে কী করতে পারি? তখন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহযোগী বদরুন্নেসা আমার খুব ঘনিষ্ঠ আপা ছিলেন। আর আশীর্বাদ নিতে গেলাম সুফিয়া কামালের কাছে। তিনি সব সময় আমাদের পথ দেখিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেই সময়ে তারুণ্য আমাদের দুই কাঁধের ওপর ভর করে ছিল। আমরা ছুটতাম বাতাসের বেগে। গার্ল গাইডের প্রথম কাজই ছিল মানুষের জন্য গান গাওয়া। এই গান গাওয়া হলো অন্তরটা মানুষের জন্য প্রসূন হয়ে থাকা।’

মার্চে ঢাকা ছাড়ার কথা উল্লেখ করে মালেকা খান বলেন, ‘আমরা ঢাকা ত্যাগ করলাম ২৯ মার্চ। নদী পার হয়ে দেখলাম মুক্তাঞ্চল। ঢাকা থেকে যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁদের পানি দিয়ে সাহায্য করা হচ্ছে। যে যেভাবে পারছে সাহায্য করছে। সে এক অভূতপূর্ণ সময় ছিল, বাঙালির প্রতি বাঙালির ভালোবাসা ছিল। ১৯৭১-কে আমরা বলতাম, কয়েকজন রাজাকার ছাড়া সবাই মুক্তিযোদ্ধা। এমন কোনো পরিবার ছিল না, ছোট–বড় সবাই কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত ছিল।’

একটি ঘটনার উল্লেখ করে মালেকা খান বলছেন, ‘অক্টোবর কি নভেম্বরের শেষ হবে। তখন ব্রিগেডিয়ার বশীর নামে একজন অত্যাচারী অফিসার ছিলেন। তিনি আমাদের গার্ল গাইডের কমিশনারকে অনুরোধ করলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য। তখন কমিশনার ছিলেন তাহেরা আপা। ডেপুটি কমিশনার ছিলেন আফিফা হক। আমি ছিলাম সেক্রেটারি। আমরা ব্রিগেডিয়ার বশীরের ওখানে গেলাম। জায়গাটা ছিল নাখালপাড়া এমপি হোস্টেলে। সেখানে একমাত্র তরুণ ছিলাম আমি। আমার ভয় লাগছিল। ঘরটির মধ্যে অনেক ম্যাপ ছিল। পূর্ব বাংলার সমগ্র অংশের খণ্ড খণ্ড ম্যাপ ছিল, আবার বড় ম্যাপও ছিল। তাহেরা আপাকে বশীর বললেন বিশাল করে গার্ল গাইডের র‍্যালি বের করতে। তখন তাহেরা আপা কোনোমতো বললেন চেষ্টা করবেন। কথা বাড়ালেন না। হঠাৎ করে আফিফা আপাকে ব্রিগেডিয়ার বশীর বলতে লাগলেন, দেশের অবস্থা তো এখন ভালো, কাজেই আপনারা এখন এটা করতে পারেন। এই কথার পৃষ্ঠে আফিফা হক বললেন, কী বলছেন? দেশের অবস্থা ভালো? আমার বাড়ির যে লোকজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ভাগনেরা কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছে? তাঁদের কেন ধরে ধরে মারা হচ্ছে? কেন মেয়েদের ধরে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে রাখা হচ্ছে? আপনি বলছেন দেশের অবস্থা ভালো? আমি আর তাহেরা আমরা পিঠ পেতে দিচ্ছি, যত খুশি দোররা আমাদের পিঠে মারেন। কিন্তু বন্দী মেয়েদের ছেড়ে দেন।’

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারী অফিসারের কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে মালেকা খান বলেন, ‘আমরা যখন এমপি হোস্টেল থেকে বেরিয়ে আসছিলাম, তখন দেখি দেয়ালে-মেঝেতে রক্ত। মনে হয় যে কত মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়েছে। রক্ত ছিটে ছিটে দেয়ালে গেছে। আমার নিজের চোখে দেখা। তারপর কী করে বলব যে পাকিস্তানিরা ভালো কাজ করছে?’ তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ওপর কত কত নির্যাতন হয়েছে। কত নারীকে তাঁর পরিবার নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। অনেকে আত্মহত্যা করেছে। আবার কেউ কেউ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন বলার সময় এসেছে। যেহেতু অনেক জায়গায় ভুল হয়ে গেছে, সে জন্য যারা যা জানেন, আপনারা বলে যান। এক লাইন জানলেও বলে যান।’

দেশ স্বাধীনের পরের ঘটনা উল্লেখ করে মালেকা খান বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে দুটি দাবি নিয়ে গেলাম। একটি হলো আন্তদেশীয় দত্তক আইন। আরেকটি হলো গর্ভপাত আইন। যাতে মেয়েদের বাঁচানো যায়। কারণ, চিকিৎসকেরা নিজে দায়িত্ব নিয়ে এগুলো করতে চাননি। এরপর অনেককে বাঁচানো সম্ভব হলো। এ সময় তিনি আরও যোগ করেন, পাকিস্তানি আর্মিরা মেয়েদের চুলের মুঠি ধরে জিপে তুলত। বুটজুতা দিয়ে লাথি দিত। বেয়নেট দিয়ে গুঁতো দিত। অনেক মেয়েকে একসঙ্গে রাখা হতো। মেয়েদের অত্যাচার করার পর গুলি করে ফেলে রেখে যেত। আবার অনেক মেয়েকে সেখানেই রেখে যেত। কত কষ্ট করেছে ১৯৭১-এর মেয়েরা। আমরা সতেরো-আঠারো শতাব্দী দেখিনি এবং ইংরেজদের অত্যাচার ওভাবে দেখিনি। সব অত্যাচারের চেয়ে বীভৎস অত্যাচার ১৯৭১-এ হয়েছে বাংলাদেশে, সাত কোটি মানুষের ওপর।’

নিজের কষ্টের কথা জানিয়ে দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ মালেকা খান বলেন, ‘আমি আজও একটা ভালো কাপড় পরতে পারি না। একটা কাপড় ধরলে আমার মনে হয়, এখনো কী সময় হয়েছে আমাদের নিজেদের কথা ভাবার? আমাদের এই প্রজন্মের মানুষেরা হাসছে-খেলছে, কেমন সব হয়ে গেছে। আমাদের একবারও জিজ্ঞেস করে না আপনারা কেমন ছিলেন? কেন আমাদের মধ্যে এতটা গ্যাপ হয়ে গেল? এটা নিয়ে আমি খু্ব চিন্তিত। আমি আর কয় দিন বাঁচব জানি না, সে জন্য আমি আমার জন্মতারিখটা দিয়ে গেছি, যাতে আপনারা বুঝতে পারেন আমার অনেক বয়স হয়েছে।’