Thank you for trying Sticky AMP!!

৫ বছরেই সম্পদের পাহাড়

.

গত পাঁচ বছরে প্রায় পাঁচ কোটি টাকায় ৭০ একর জমি কিনেছেন। এর মধ্যে ৬৬ একরই সুন্দরবনের পাশে বাগেরহাটের মংলা উপজেলার জয়মনিগোল গ্রামে। তিন কোটি টাকা বিনিয়োগ করে প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনটি নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। গাজীপুরে কিনেছেন তিন একর জমি। হাতে আছে আরও প্রায় ৪৪ লাখ টাকা। স্ত্রী ও নিজের নামে শেয়ার কেনা আছে এক কোটি ২২ লাখ টাকার। এক কোটি ১৮ লাখ টাকায় দুটি গাড়িও কিনেছেন।
এই ‘সফল’ ব্যক্তিটি হলেন মাহবুব উল আলম হানিফ, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। কিছুদিন আগ পর্যন্ত এ সরকারের প্রায় পুরো মেয়াদেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ছিলেন।
বিপুল এই সম্পদের হিসাব হানিফের নিজেরই দেওয়া। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়া হলফনামায় হানিফ এ তথ্য দিয়েছেন। তবে এই হিসাবের বাইরে বেনামে আরও সম্পদ রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
হলফনামায় হানিফ লিখেছেন, নতুন তিন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর কোনো আয় হয় না। প্রধান আয়ের উৎস হিসেবে তিনি মৎস্য খাতের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর দাবি, বছরে সেখান থেকে আয় তিন কোটি ৭০ লাখ টাকা। তবে মৎস্য খামারটি কোথায়, তার উল্লেখ করেননি।
জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি জানান, খুলনার দাকোপ ও পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালিতে তাঁর মাছের ঘের রয়েছে। সেখান থেকেই ওই আয় হয়। কিন্তু ওই দুই জায়গায় প্রথম আলো অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারে, নব্বইয়ের দশকের দিকে তিনি সেখানে দুটি মাছের ঘের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দুটিই বর্তমানে বন্ধ। হানিফের দাবি, বেশ কয়েকটি খামারে তার অংশীদারি রয়েছে। সেখান থেকেও তাঁর আয় হয়।
পরিবেশ আইন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন নিষিদ্ধ। কিন্তু হানিফের কেনা জমি সুন্দরবনের ২০০ মিটারের মধ্যে। সেখানে একটি শিপইয়ার্ড স্থাপনের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অবস্থানগত ছাড়পত্রও নিয়েছে হানিফের প্রতিষ্ঠিত সানমেরিন শিপইয়ার্ড লি.।
বর্তমান সরকারের আমলে ২০১০ সালে নিবন্ধন পাওয়া সানমেরিন শিপইয়ার্ড কোয়েস্ট গ্রুপ অব কোম্পানির একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। কোয়েস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহবুব উল আলম হানিফ। আর সানমেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাঁর ভায়রা কাজী হাসান শরীফ। তাঁর নামেও জয়মনিগোল গ্রামে ১৮০ একর জমি কেনা হয়েছে।
এই জমি কেনা এবং শিপইয়ার্ড স্থাপন সম্পর্কে জানতে চাইলে মাহবুব উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জয়মনিতে খাদ্য বিভাগ গুদাম নির্মাণ করেছে। নৌবাহিনী একটি শিপইয়ার্ড তৈরি করছে। আমরাও বিদেশি বিনিয়োগ মাথায় রেখে সেখানে জমি নিয়েছি। সেখানে শিপইয়ার্ড স্থাপনের জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহও দেখিয়েছে। তবে কোনো আইন লঙ্ঘন করে বা সরকার অনুমোদন না দিলে সেখানে শিপইয়ার্ড স্থাপন করা হবে না।
আয়কর বিবরণীতে বলা হয়েছে, মাহবুব উল আলম ব্যবসায় এক কোটি ১০ লাখ ১০ হাজার টাকা পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন। আরও চারটি প্রতিষ্ঠানে তাঁর শেয়ার রয়েছে। এর মধ্যে কোয়েস্ট ইন্টারন্যাশনালে তিন লাখ ২৫ হাজার টাকা, লুনা এভিয়েশন অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডে ১০ লাখ, সানমেরিন শিপইয়ার্ডে ৮০ লাখ, ব্লু লাইন এয়ার সার্ভিসেস লিমিটেডে ১০ লাখ টাকা তাঁর বিনিয়োগ রয়েছে।
ওয়েবসাইটে কোয়েস্ট গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে এইচআরএফ ইঞ্জিনিয়ারিং লি., এমবি ট্রেডার্স, কেসিওপিয়া ইনকের কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এই তিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা তিনি হলফনামায় উল্লেখ করেননি। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ভবনের অষ্টম তলায় কোয়েস্ট গ্রুপের প্রধান কার্যালয়।
ওয়েবসাইটে আছে, হলফনামায় ওই তিন প্রতিষ্ঠানের নাম নেই কেন? জানতে চাইলে হানিফ বলেন, ওয়েবসাইটে ভুলে তিন প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে তাঁর দাবি।
হলফনামায় হানিফের সম্পত্তি হিসেবে কোনো কৃষিজমি থাকার কথা উল্লেখ নেই। কিন্তু মংলা ভূমি নিবন্ধন কার্যালয় থেকে তাঁর জমির ৩০টি দলিলের অনুলিপি পাওয়া গেছে। মংলা উপজেলা ভূমি নিবন্ধন কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হানিফের নামে কেনা জমির পুরোটাই কৃষিজমি।
সম্পদ ও আয়: গাজীপুরে এক কোটি ৯৮ লাখ টাকায় তিন একর জমি, বাগেরহাটের মংলা উপজেলার জয়মনিতে দুই কোটি ৯৪ লাখ ৫৪ হাজার ২৭৬ টাকা দিয়ে ৬৬ দশমিক ৫৯৩ একর জমি, জয়মনিতেই দশমিক ৭০ একর জমি দুই লাখ ৮৬ হাজার টাকায়, কুষ্টিয়ার জোড়হাঁসে ১১ লাখ টাকায় জমি কিনে সেখানে ২০ লাখ টাকায় একটি বাড়ি নির্মাণ করছেন তিনি। এ ছাড়া সানমেরিন শিপইয়ার্ডে শেয়ার কেনা বাবদ অগ্রিম দুই কোটি ১০ লাখ টাকা জমা দিয়েছেন এবং সুদমুক্ত ঋণ হিসেবে তিনি দিয়েছেন এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা।
হানিফ তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির কথা উল্লেখ করতে গিয়ে হলফনামায় লিখেছেন, এক কোটি পাঁচ লাখ ও ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা দামের দুটি গাড়ি রয়েছে তাঁর। এ ছাড়া নগদ ও ব্যাংকে মিলিয়ে তাঁর মোট ব্যবসাবহির্ভূত অর্থের পরিমাণ ৪৪ লাখ ৬০ হাজার ৬২৮ টাকা। গত অর্থবছরে হানিফ মোট ২০ লাখ ৩০ হাজার ৪০৫ টাকা আয়কর দিয়েছেন। গত বছর মোট ব্যয়ের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৩৬ লাখ ১৯ হাজার ৯৪৫ টাকা। ব্যাংকঋণ শোধ করেছেন ৩১ লাখ ১৫ হাজার ৩০৫ টাকা।
বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, দোকান ভাড়া থেকে তিনি বছরে সাত লাখ ২৩ হাজার ৮০০ টাকা আয় করেন। চাকরি বাবদ বার্ষিক আয় দেখানো হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং ব্যাংক সুদ বাবদ বছরে চার হাজার ৭৯৯ টাকা দেখানো হয়েছে।
এ ছাড়া হানিফের নামে ন্যাশনাল ব্যাংক কারওয়ান বাজার শাখা থেকে ১২ কোটি ৫০ লাখ ও এক কোটি ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৯৭ টাকা এবং রূপালী ব্যাংক কুষ্টিয়া শাখা থেকে ৩৫ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে।
ব্যবসা শুরু: প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যবসায়ী হিসেবে মাহবুব উল আলম হানিফের যাত্রা শুরু ১৯৮৬ সালে। সে সময় তিনি কুষ্টিয়া থেকে খুলনায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। খুলনার দাকোপ উপজেলায় একটি চিংড়িঘের স্থাপন করেন তিনি। ’৯০ সালের পর খুলনা ছেড়ে আবার কুষ্টিয়ায় ফিরে যান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয় পরিচয়ই তাঁকে অল্প সময়ের মধ্যে দলের ভেতরে-বাইরে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে সাহায্য করে। ২০০৪ সাল পর্যন্ত হানিফ কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের একজন সাধারণ সদস্য ছিলেন। ওই বছর অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুষ্টিয়া-২ আসন থেকে মনোনয়ন চান তিনি। সেখানে মহাজোটের শরিক জাসদের (ইনু) সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে মহাজোটের প্রার্থী করা হয়।
মনোনয়ন না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হানিফকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পান তিনি। পরে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলেও সংসদ নির্বাচনে অন্য এলাকা (কুষ্টিয়া-৩) থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের কারণ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ক বড় ভূমিকা রেখেছে। হানিফের বড় ভাইয়ের সঙ্গে শেখ হাসিনার ফুফুতো বোনের বিয়ে হয়। ওই হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই হন হানিফ।
দলীয় ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়ার পর মাহবুব উল আলম হানিফ তাঁর প্রভাব কাজে লাগিয়ে অনেকগুলো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বিপুল সম্পত্তির মালিক হন। এর মধ্যে নিজের নামে নিবন্ধিত ও ব্যাংকে গচ্ছিত সম্পত্তির হিসাব হলফনামায় উল্লেখ করলেও এর বাইরে বেনামে ও আত্মীয়স্বজনের নামে বিপুল সম্পত্তি কিনেছেন বলে অভিযোগ আছে।
ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করা হয় যে, বড় বড় সরকারি ক্রয়, টেন্ডার ও লেনদেনের ক্ষেত্রে হানিফ তাঁর প্রভাব কাজে লাগিয়ে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। এ ছাড়া সরকারি প্রকল্পে নিয়োগ-বদলির ক্ষেত্রে তদবিরকারী হিসেবে বর্তমান সরকারের পাঁচ বছরে আলোচিত-সমালোচিত হন তিনি।