Thank you for trying Sticky AMP!!

৮৬ বছর পেরিয়ে মুর্তজা বশীর

মুর্তজা বশীর। ছবি: খালেদ সরকার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের ড. হাসান সাহেবের কুটির। সলিমুল্লাহ হলের ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট হিসেবে সেখানে পরিবার নিয়ে থাকেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ১৯৩২ সাল। সন্তানসম্ভবা তাঁর স্ত্রী হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। অনাগত শিশুর একটা হাত বেরিয়ে এল মায়ের গর্ভাবস্থা থেকে। ডা. বোস বললেন, প্রসূতির জীবন বাঁচাতে শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। মা মরগুবা খাতুন মানলেন না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন টানা দুই দিন। অসহনীয় বেদনা সহ্য করে জন্ম দিলেন যে সন্তানের, সেই সন্তানের আজ ৮৬তম জন্মবার্ষিকী।

গত বুধবার সকালবেলা তাঁর বাসায় গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, জন্মদিনে কী করেন?
আমি মানুষটা বোহিমিয়ান হলেও পারিবারিক। পরিবারের সঙ্গেই কাটে। বড় মেয়ে জুঁই তো রোজই আসে নিয়ম করে, ছোট মেয়ে ঢাকার বাইরে থেকে এক দিনের জন্য আসবে।

ছোটবেলায় মা কী করতেন?
কিছুই হতো না। ছেলেমেয়েরা বড় হওয়ার পরই ঘরে জন্মদিন পালন করে। এ ছাড়া একসময় শিল্পী বন্ধু আমিনুল ইসলাম আর দেবদাস চক্রবর্তীর সঙ্গে আড্ডা দিতাম এই দিনে। ব্যস।

মুর্তজা বশীর একাধারে শিল্পী, গবেষক, লেখক। জিজ্ঞেস করি, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কোন পরিচয়ে বেঁচে থাকলে খুশি হবেন বেশি? বললেন, মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ এই গবেষণার জন্য। এটাই হয়তো অন্য অনেক শিল্পীর চেয়ে মুর্তজা বশীরকে আলাদা করে দেয়। যিনি ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশনার (হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত) জন্য বিখ্যাত লিনোকাট ‘ব্লাডি ২১’ এঁকেছেন, সেই মানুষটিই আলট্রামেরীন-এর মতো উপন্যাস লিখেছেন। আবার তিনিই দীর্ঘ সাত বছর গবেষণা করেছেন হাবশী সুলতানদের নিয়ে। তাঁর ডাকটিকিট আর মুদ্রা সংগ্রহের ভান্ডার রীতিমতো ঈর্ষণীয়। তাঁর অটোগ্রাফের খাতায় এমন সব ব্যক্তিত্বের স্বাক্ষর, যা ইতিহাসের অংশ। সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে নেহরু...। গল্পে গল্পে জানলাম, ১৯৬৫ সালে যখন সোনার ভরি ছিল ৮০ টাকা, তখন একটা দুর্লভ ডাকটিকিট কিনেছিলেন ৫০০ টাকায়! নিয়মিত ফেসবুকে থাকেন নতুন মুদ্রা আর ডাকটিকিটের ডিলারদের খোঁজে।

আপনার প্রিয় শিল্পী কে?
আমি আরলি রেনেসাঁর ভক্ত। রেনেসাঁ আমায় টানে না। জঁত্তো, সিমাব্যু, ফ্রাঁ অ্যাঞ্জেলিকো আমার প্রিয় শিল্পী। আধুনিকদের মধ্যে মোদিগ্লিয়ানি ছিলেন প্রিয়। তাঁর জীবদ্দশায় অশ্লীলতার অভিযোগে প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৫৮ সালে আমি ইতালিতে। খবর পেলাম, সারা পৃথিবী থেকে এই শিল্পীর কাজ নিয়ে প্যারিসে প্রদর্শনী হবে। ভিসার কড়াকড়ি তখন। কনসাল জেনারেলের কাছে গেলাম, ট্রানজিট দিতে রাজি, এর বেশি নয়। বললাম, তবে আমি হেঁটে রওনা হই। তিনি বললেন, কেন, বান্ধবী আছে নাকি? প্রদর্শনী দেখার কথা শুনে ভিসা দিলেন। কিন্তু পুরো প্রদর্শনী দেখে বেরিয়ে আমি সিঁড়িতে বসে কিছুই মনে করতে পারি না। সব এক রকম ছবি। বুঝলাম, আমি ভুল গুরু ধরেছি। সেই থেকে আমি পিকাসোর ভক্ত। ছাত্রজীবনে জয়নুল আবেদিন আমাদের লাইব্রেরিতে যেতে দিতেন না, যাতে অন্যের কাজে প্রভাবিত না হয়ে নিজের ধারা তৈরি করতে পারি। আমি মনে করি, যে শিল্পী সময়ের আগে গিয়ে কাজ করেন, তিনিই বেঁচে থাকেন।

গত বছর যেদিন আপনার স্ত্রী চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে, আপনি বলেছিলেন, ‘এখন অখণ্ড সময় পাব, শুধু ছবি আঁকব।’ আঁকছেন?
না, সেভাবে হচ্ছে না। সারা দিন বসে ভাবি কিন্তু আঁকা হয় না। তবে আঁকব। অক্টোবরে একটা প্রদর্শনী করব। ১৯টা বা ২৮টা কাজ থাকবে।

এমন সংখ্যা কেন?
আমি আমার জন্য এমন সংখ্যাকে সৌভাগ্যের মনে করি। যোগফল ১০ হতে হবে। শূন্য বাদ দিলে ১। একাত্তরের আগে আমি ইংরেজি বানান লিখতাম, যা গণনা বিশারদ কিরোর ফর্মুলায় যোগফল হতো ৪। আমার জীবনে শুধু বাধা। একাত্তরে একজন আমাকে বললেন, নামের বানান বদলে যোগফল ১ করুন। করলাম। ফলও পেলাম, তাই মেনে চলি।

শেষ প্রশ্ন। ছবি আঁকেন কেন? মনের আনন্দে?
না, ছবি আঁকি বেঁচে থাকার জন্য। জীবন ধারণের জন্য এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। সেই যে কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৪৯ সালে, সেই থেকেই। তবে হ্যাঁ, ছবি আঁকার পর আনন্দ পেয়েছি অনেক। এখনো পাই।