Thank you for trying Sticky AMP!!

'আবাদ শ্যাষ করি দিয়া গেইছে'

কুড়িগ্রামে বন্যার পানি নেমে গেলেও সবজিখেত রক্ষা পায়নি। ছবি: সফি খান

‘পানি সেন নামি গেইল। আবাদ শ্যাষ করি দিয়া গেইছে।’ বন্যার পানিতে পচে যাওয়া সবজির খেত দেখিয়ে কথাগুলো বলছিলেন সামিনা বেগম। কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার ধরলা নদীর পারে তাঁর বাড়ি।

বন্যার পানিতে সবজিখেত শেষ সামিনার। পানি নেমে গেলেও তাই আবাদ নিয়ে আশা হারিয়েছেন। বললেন, ‘দুই মাস বানের পানিত থাকতে সবজি গাছ ও বাঁশের জাংলি (বাঁশের তৈরি মাচাবিশেষ) পচি গেইছে। তাকে টানি খুলবার নাগছি। খড়ি করমো।’
আজ শুক্রবার সকালে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ধরলা নদীর পূর্ব পার পাঁচগাছি ইউনিয়নের উত্তর নওয়াবশ গ্রামে গিয়ে দেখা যায় তিনজন নারী ও শিশু মিলে পটলখেতের জাংলি খুলছেন। জমিগুলোর দিকে তাকালে যে কারও কষ্ট হবে। যত দূর চোখ যায়, এভাবে জাংলিগুলো পড়ে আছে। তাতে পটলের পচা ডালগুলো ঝুলে আছে। নারীরা জাংলি টেনে তুলছেন।
কাছে গিয়ে জাংলি খোলার কারণ জানতে চাইলে সামিনা বেগম বলেন, ‘এগলা থুইয়া আর কী হইবে। পচি গেইছে। খুলি পাকসাক করমো। আবাদ করলে ফির নয়া জাংলি দেওয়া যাইবে।’
সামিনা বেগম আরও বলেন, পরপর তিনবারের বন্যায় তাঁর গচ্ছিত টাকার সব শেষ। সবজিখেতের জন্য বীজ, চারা বা সার কেনার উপায় নেই। এক বিঘা জমিতে সবজিখেত করতে ২৫–৩০ হাজার টাকা লাগে। এত টাকা জোগাড় করার সাধ্যও নেই তাঁর।
রাশেদা বেগম নামের আরেকজন নারী বললেন, তাঁর স্বামী হামিদুল ইসলাম দিনমজুর। কাজের সূত্রে বাড়ির বাইরে থাকেন। আধা বিঘা জমি বর্গা নিয়ে পটল আবাদ করেছিলেন। এই খেত তাঁর তত্ত্বাবধানে থাকে। তিনি বলেন, ‘জমি আমাকে দেখা নাগে। প্রথম দিকে কিছু সবজি বেচাইছিলাম। তারপর পানি আসি সব ঢুবি গেল। পূর্ব দিকে ও উত্তর দিকের জমিগুলাত এ্যালাও পানি।’
সেখান থেকে পূর্ব দিকে এগিয়ে দেখা যায় বিধ্বস্ত অবস্থা। পানির প্রবল স্রোতে জমিতে মাঝেমধ্যে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। তাতে পানি জমে আছে। জাংলিগুলো ভেঙে পড়ে আছে। কোথাও কোথাও পানি জমে আছে। পাট ও বেগুনগাছ পানিতে থেকে পচে গেছে।
গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম জানান, গ্রামের কয়েক শ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ হয়। সব নষ্ট হয়ে গেছে।
রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, শুধু এ এলাকা নয়, ধরলা নদীর দুই পারের ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় ১০টি ইউনিয়ন সবজি আবাদের জন্য বিখ্যাত। এই বন্যায় হাজার হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
কৃষক রফিকুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একটু জায়গার মাটি কেটে উঁচু করে বেগুনের চারা তৈরি করেছেন। চারদিকে পলিথিন দিয়ে ঘেরা।
রফিকুলের বড় ভাই সফিকুল ইসলাম বলেন, ১৫ দিন আগে বেগুনের বীজ এনে লাগিয়েছেন। ১ হাজার ২০০ চারা হয়েছে। দেড় মাস পর ১২ শতক জমিতে লাগাতে পারবেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘জমি ফেলে থুইলে হামারে মরণ। করোনার পরপর বন্যা। বাড়ি বসি। হাওলাদ–বাওলাদ করি চলবার নাগছি। কাম হইলে ট্যাকা ফেরত দেম। শত কষ্টের মধ্যে সেই ট্যাকায় বীজ কিনি চারা করছি। লাগাইতে দুই হাজার ট্যাকার সার নাগবে। ট্যাকা তো নাই।’
মোগলবাসা ইউনিয়নের চর সিতাইঝার, কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের শিবরাম, চর কদমতলা, দক্ষিণ নওয়াবশ গিয়ে দেখা যায় একই অবস্থা। ঝিঙা, করলা, মরিচ, বেগুন ও পটলগাছ মরে মাটিতে পড়ে আছে। কোনো কোনো জমিতে বালু পড়ে উঁচু হয়ে আছে। বিশেষ করে কাঁঠালবাড়ী এলাকায় কয়েক শ বিঘা মরিচ ও করলা নষ্ট হয়ে গেছে। এ এলাকার কৃষক আবদুল মজিদ বলেন, পানি দীর্ঘদিন থাকায় মরিচ নষ্ট হয়ে গেছে।
কদমতলার ভূমিহীন কৃষক এরশাদুল হক বলেন, ‘কামলা দিয়া কিছু ট্যাকা জমাইছিলাম। সেই ট্যাকায় দুই বিঘা জমি বর্গা নিয়া সবজি আবাদ করছি। ৩০ হাজার ট্যাকা খরচ। আট হাজার ট্যাকার ঝিঙা ও পটল বিক্রি করতে পারছি। এ্যালা আবাদ করি কী দিয়া। ছাওয়া–পাওয়াক বাঁচাই কেমন করি।’
একই গ্রামের মো. হাসান আলী জানান, তাঁদের এলাকায় সব ধরনের সবজি হয়। তবে পটল ও বেগুনের আবাদ বেশি হয়।
কুড়িগ্রামের কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, তিন দফা বন্যায় জেলায় মোট ৯৫৩ হেক্টর জমির সবজি নষ্ট হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোস্তাফিজার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সবজির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বরাদ্দের অর্থ পাওয়া গেলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।