Thank you for trying Sticky AMP!!

হোলি আর্টিজানে হামলা নিয়ে এক প্রতিবেশীর বর্ণনা

প্রতিদিন রাতের আহারে ভাত নয়, পাউরুটি পছন্দ করেন তিনি। এর সঙ্গে খানিকটা পনির। পাউরুটি একটু টাটকা চাই। সে জন্য রাতের বেলাতেই এটি কিনে থাকেন সাখাওয়াত খান। টাটকা, নরম ও খেতে সুস্বাদু হওয়ায় পাউরুটির জন্য বাড়ির পাশের এক বেকারি ছিল তাঁর পছন্দের। ‘ছিল’ শব্দটিই তিনি উচ্চারণ করেছেন, কারণ ওই বেকারির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে এক ভয়াবহ ঘটনা। সেই ভয়াবহতা তাঁকে এতটাই গ্রাস করেছে যে পছন্দের বেকারি থেকেই তিনি ছিটকে পড়েছেন। এখনো ওই সড়কের পাশ দিয়ে যেতেও আতঙ্কে শিউরে ওঠেন তিনি।

এখানেই ছিল হোলি আর্টিজান বেকারি। এখন সেটি সরিয়ে অন্য জায়গায় নেওয়া হয়েছে। ছবি: দীপু মালাকার

নিজের ব্যবসার পাশাপাশি সাংবাদিকতাও করে থাকেন সাখাওয়াত খান। রাজধানী ঢাকার গুলশান ২ নম্বরের ৭৮ নম্বর সড়কের ১ নম্বরের একটি বহুতল বাড়ির ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বসবাস করেন তিনি। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। হাত দিয়ে দেখালেন পাশের সড়কেই ছিল সেই বেকারি স্প্যানিশ রেস্তোরাঁ ‘হোলি আর্টিজান বেকারি’। নামটি উচ্চারণ করেই কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন সাখাওয়াত খান। মনে হলো যেন এক ঝটকায় হুড়মুড় করে অনেক কিছুই তাঁর চোখের সামনে এসে হাজির হয়েছে। থেমে থেমে বললেন, ‘আমি এখন সেখানে যাই না।’

হোলি আর্টিজানটি যে সড়কে ছিল, সেটা দেখিয়ে হামলার সময়ের কথা বলছিলেন সাখাওয়াত খান। ছবি: দীপু মালাকার

দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে গতকাল শুক্রবার বিকেলে সাখাওয়াত খান বলা শুরু করলেন, দুই বছর আগে হোলি আর্টিজান বেকারিতে ঘটে যাওয়া জঙ্গি হামলার সময়ের কথা।

কথা বলতে বলতেই বাড়ির সামনে থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন ৭৯ নম্বর সড়কের মাঝামাঝি। এরপরই থমকে গেলেন সাখাওয়াত খান। বললেন, ‘এক রাতের হামলায় এত লোককে যে মারা হবে, সেটি আমার কল্পনারও বাইরে। তাও আবার আমার পাশের হোলি আর্টিজান বেকারিতে।’

ওই সড়কের প্রবেশমুখে ক্রসবার লাগিয়ে নিরাপত্তা প্রহরা চলে। ছবি: দীপু মালাকার

হোলি আর্টিজান বেকারির সঙ্গে নিজের বাসার দূরত্ব দেখিয়ে সাখাওয়াত খান বলেন, ‘আমার বাড়ি ৭৯ নম্বর সড়কের ১ নম্বর প্লটটি। এই বাড়ির ছয়তলায় আমার ফ্ল্যাট। এখান থেকে হোলি আর্টিজান বেকারির দূরত্ব মাত্র ২০০ গজের মতো। তবে হামলার একটি ঝাপটা আমার বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে গিয়েছিল।’

২০১৬ সালের ১ জুলাই, শুক্রবার রাত নয়টায় হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় ২০ জনকে হত্যা করা হয়। নিহত ২০ জনের মধ্যে নয়জন ইতালির নাগরিক, সাতজন জাপানের ও একজন ভারতের নাগরিক। বাকি তিনজন বাংলাদেশি। তাঁরা হলেন, ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেন, ঢাকার ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান ক্রিয়েটিভসের সাবেক পরিচালক ইশরাত আখন্দ এবং ল্যাভেন্ডার গ্রুপের মালিক মনজুর মোরশেদের নাতনি অবিন্তা কবীর।

হামলার সময়ের কথা বলতে গিয়ে থেমে থেমে এমন বিষণ্ন হয়ে পড়েন সাখাওয়াত খান। ছবি: দীপু মালাকার



এসব কথা মনে করে সাখাওয়াত খান বলেন, ‘আমি নিজেও ঘটনার শিকার হয়ে যেতাম।’ কারণ জানতে চাইলে কিছু সময় ৭৯ নম্বর রোডের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘১ জুলাই রাত সাড়ে আটটার দিকে হোলি আর্টিজান বেকারিতে পাউরুটি কিনতে যাব। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় শুনি পনিরও শেষ হয়ে গেছে। তবে পনির পাওয়া যায় অন্য আরেকটি দোকানে। তাই প্রথমে যাই পনির কিনতে। কিন্তু দোকানটিতে গিয়ে দেখি পনিরও নেই। তাই পাউরুটি কিনতে হোলি আর্টিজান বেকারিতে যাইনি। নয়টার দিকে বাসায় ফিরে আসি। ঘরে আসার পরপরই শব্দ কানে আসে। প্রথমে মনে হয়েছিল হয়তো আশপাশে কোথাও পটকা ফোটানো হয়েছে। খানিক পর পুলিশ এসে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। এরপর গোলাগুলির আরও শব্দ বাড়তে থাকে। আরও পরে আটকে পড়া লোকদের স্বজনেরা আমাদের বাড়ির গেটের সামনে জড়ো হন। তখনই বুঝতে পারি বড় কিছু ঘটতে চলেছে।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা উদ্বিগ্ন পরিবারের স্বজনেরা সাখাওয়াত খানের বাড়ির সামনে অপেক্ষায় ছিলেন। প্রতিবেশী কারও বাড়ি থেকে বের হওয়ার সুযোগ ছিল না। সাখাওয়াত খান বলেন, ‌‌‘আমরা ফ্ল্যাটের লোকেরা বের হয়ে উদ্বিগ্ন লোকদের ভেতরে আনতে যাই। কিন্তু গেটের বাইরে থেকে আমাদের বের হতে নিষেধ করা হয়। তাই তাকিয়ে দেখা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।’

হামলার পরদিন ২ জুলাই শনিবার সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে সেনাবাহিনীর এয়ার কমান্ডোর নেতৃত্বে কমান্ডো অভিযান শুরু হয়। ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যেই সব সন্ত্রাসীকে নির্মূল করে ওই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। অভিযানে পাঁচজন হামলাকারী ঘটনাস্থলেই নিহত হন। ১২ ঘণ্টার এই জিম্মি ঘটনায় ২০ জিম্মি, ছয় সন্ত্রাসী, দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২৮ জন নিহত হন। আহত হন অন্তত ২০ জন পুলিশ সদস্য।

হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কমান্ডো অভিযানের পরের চিত্র। ছবি: প্রথম আলো

সারা রাত নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে জানিয়ে সাখাওয়াত খান বলেন, ‘সকালবেলা মুহুর্মুহু গোলাগুলির ঘটনা ঘটতে থাকে। অভিযান শুরুর আগে সেনাসদস্যরা একে একে হোলি আর্টিজানের দিকে যাচ্ছিলেন। আর আটকে পড়া লোকজনের স্বজনেরা মোবাইল ফোন নিয়ে সেনাসদস্যদের কাছে ছুটোছুটি করছিলেন। সেই দৃশ্য আজও ভুলিনি। সৈন্যদের কাছে তাঁরা যাচ্ছেন আর ছবি দেখিয়ে বলছিলেন, আমার ভাইটিকে, বোনটিকে বা ছেলেটিকে একটু দেখেন। স্বজনের জন্য মানুষের যে কত আকুতি সেদিন আমি বুঝেছিলাম।’

সাখাওয়াত খান বলেন, ‘লাশ নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি ছিল আরও বেদনাবিধুর। আমার মতো প্রতিবেশীরা সবাই ছুটোছুটি করছিলেন। যে যার মতো সাহায্য করার চেষ্টাও করছিলেন। কিন্তু তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। রাতভর বৃষ্টি শেষে সকালে আমাদের সামনে দিয়ে জিম্মিদের বের করা হয়। এরপর দুপুরের দিকে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশগুলো বের করে নেওয়া হয়। তখন স্বজনদের সেকি আহাজারি। কেউ অ্যাম্বুলেন্সের সামনে গিয়ে পথ আগলে ধরছিলেন। কেউবা কাচ দিয়ে ভেতরের থাকা লাশগুলো একপলক দেখার চেষ্টায় ছটফট করছিলেন। ঘটনার দুটি বছর পেরিয়ে গেল। কিন্তু এখনো মনে হয়, এই তো সেদিন চোখের সামনে ঘটে গেল লোমহর্ষক সেদিনের ঘটনা। সবই যেন চোখের সামনে ভাসছে।’

ওই ঘটনায় এখনো আতঙ্কে শিউরে ওঠেন জানিয়ে সাখাওয়াত খান বলেন, ‘হোলি আর্টিজানে হামলার সময় আমার ছেলের বয়স ১৮ বছর ছিল। এক বছর পর্যন্ত সে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি। এখনো আমরা ওই সময়ের কথা বলি, আর আতঙ্কে শিউরে উঠি। রাতে একটু শব্দ হলেই ঘুম ভেঙে উঠে যাই।’

হোলি আর্টিজানে হামলার পর সেনা তৎপরতা। ছবি: প্রথম আলো

যেভাবে আছে হোলি আর্টিজান
গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কটিতে হাঁটলে বোঝা যাবে না যে ৭৩০ দিন আগে এখানে কত নির্মম জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছিল। পিচঢালা নতুন চকচকে সড়ক। রাস্তার ওপর একটুও ময়লা আবর্জনা নেই। সড়কের দুপাশের বাড়িগুলো ঝকঝকে তকতকে। গতকাল বিকেলে দেখা গেল, ছুটির দিন হওয়ায় সড়কটি অন্য দিনের তুলনায় নীরব। শো শো করে কিছুক্ষণ পরপর একটি করে গাড়ি আসছে। নিরাপত্তাপ্রহরীরা গেট খুলে দেওয়ামাত্র গাড়িগুলো বাড়ির ভেতরে চলে যাচ্ছে। জানা গেল, বেকারিটি এখন আর ৭৯ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়িতে নেই।

৭৯ নম্বরের ওই সড়কের প্রবেশমুখে ক্রসবার ফেলে দাঁড়িয়ে আছেন নিরাপত্তাকর্মী মো. হোসেন। বাম পাশে যেখানে হোলি আর্টিজান ছিল সেখানে যেতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মী মো. হোসেন বাধা দিয়ে বলেন, ‌‘দূর থাইকা ছবি তোলেন।’

আরও পড়ুন

হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা: যখন যা ঘটেছিল

ছবিতে গুলশান হামলা

হোলি আর্টিজান: তখন ও এখন

হোলি আর্টিজানে অপেক্ষার রাত

ঝড়ের মতো ঘটেছিল সবকিছু