Thank you for trying Sticky AMP!!

'প্রশ্ন ফাঁসের বন্যার পানি শিশুদের গায়ে লাগছে'

ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র মুঠোফোনে পাওয়ায় মামলায় জড়ানো হলো চট্টগ্রামের এই কিশোরদের। অথচ প্রশ্ন ফাঁস করে যারা বন্যার পানির মতো সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে, তারা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসএসসি পরীক্ষার্থী এই শিক্ষার্থীদের বয়স ১৮ বছরের নিচে হওয়ায় তাদের স্পষ্ট ছবি দেখানো হলো না। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম আদালত ভবনে। ছবি: প্রথম আলো

‘রাষ্ট্রের ব্যর্থতায় বন্যার পানির মতো এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ভাসছে দেশ। সেই বন্যার পানি শিশুদের গায়ে লাগছে। সরকারকে আগে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’ ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র মুঠোফোনে রাখার ঘটনায় চট্টগ্রাম শহর থেকে গ্রেপ্তার করা ১১ শিক্ষার্থীর জামিন শুনানিতে গতকাল বুধবার দুপুরে আদালতে এসব কথা বলেন আইনজীবী জাফর ইকবাল।

গতকাল দুপুরে শিক্ষার্থীদের চট্টগ্রাম আদালতে হাজির করা হলে তাদের পক্ষে ৪০ আইনজীবী উপস্থিত হন। তাঁরা শিক্ষার্থীদের রিমান্ডের আবেদন না মঞ্জুর করে জামিন দেওয়ার আবেদন জানান। পরে চট্টগ্রাম মহানগর শিশু আদালতের বিচারক জান্নাতুল ফেরদৌস অভিভাবকদের কাছ থেকে হলফনামা নিয়ে আইনজীবীদের জিম্মায় ১০ শিক্ষার্থীর জামিন মঞ্জুর করেন। হলফনামা গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় একজন শিক্ষার্থীর জামিন হয়নি।

জামিন শুনানিতে আরেক আইনজীবী মঞ্জুরুল হক আনসারী বলেন, ‘যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করছে তারা আড়ালে কেন? এখানে দায়ী করা হচ্ছে যারা ঘটনার শিকার তাদের। মোবাইল, ফেসবুকের লিংকে অনেক কিছু আসে। যদি কোনো লিংক থেকে প্রশ্নপত্র আসে সেটি কোথা থেকে কারা পাঠিয়েছে, সেটি বের করতে হবে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পুলিশ সেটি বের করতে পারে। শিক্ষার্থীদের রিমান্ডে নিয়ে কি বের করা যাবে?’

গত মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম শহরের বাংলাদেশ মহিলা সমিতি (বাওয়া) বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাস থেকে ৯ শিক্ষার্থী ও ১ শিক্ষিকাকে গ্রেপ্তার করেন জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট।

একই সময়ে বাওয়া স্কুলের উল্টো দিকের রাস্তা থেকে আরও ২ শিক্ষার্থীকে (দুই বোন) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১১ শিক্ষার্থীর সঙ্গে থাকা ৭টি মুঠোফোনে এবং ২টি ট্যাবে পদার্থবিজ্ঞানের ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে ৯ জন চিটাগাং আইডিয়াল হাইস্কুলের পটিয়া শাখার এসএসসি পরীক্ষার্থী (সবাইকে বহিষ্কার করা হয়েছে)। বাকি ২ জন বাওয়া স্কুলের ছাত্রী। গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষিকাও পটিয়ার ওই স্কুলের।

শিক্ষিকাকে গতকাল পৃথক আদালতে হাজির করা হয়। তাঁর জামিন আবেদন এবং রিমান্ড শুনানির জন্য আজ বৃহস্পতিবার দিন ধার্য রেখেছেন চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম শফি উদ্দীন।

১১ শিক্ষার্থী এবং শিক্ষিকার বিরুদ্ধে ১৯৮০ সালের পাবলিক পরীক্ষা আইনে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বাওয়া স্কুলের ওই ২ ছাত্রীর বাবার বিরুদ্ধেও একই আইনে মামলা হয়েছে। তাঁদের বাবার মুঠোফোনেও প্রশ্নপত্র পাওয়া গেছে।

গ্রেপ্তার করা শিক্ষার্থীদের মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে সেখানে অভিভাবক ও আত্মীয়-স্বজনেরা ভিড় জমান। গতকাল সকাল ১০টায় কোতোয়ালি থানা প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীদের অভিভাবক, আত্মীয়-স্বজনেরা ছাড়াও সাধারণ মানুষ জড়ো হন। তাঁরা সবাই উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। থানার ভেতর থেকে কেউ বের হলেই ছুটে গিয়ে সন্তানদের অবস্থান জানতে চান। কেউ কেউ বাইরে থেকে জুস, পাউরুটি, কেক নিয়ে তা পুলিশকে দিয়ে ভেতরে পাঠান। কয়েকজন অভিভাবক হাজতে থাকা তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে দেখা করেন। সাত ছাত্রকে কোতোয়ালি থানার একটি হাজতে রাখা হয়। আরেকটি হাজতে দুই ছাত্রী এবং এক শিক্ষিকাকে রাখা হয়।

আদালত প্রাঙ্গণে এক ছাত্রীর ভাই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তাঁর বোন তো প্রশ্ন ফাঁস করেনি। সে ফেসবুকের হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্নপত্র পেয়েছে। প্রশ্নফাঁস ঠেকানোর দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তা না করে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের গ্রেপ্তার করে মামলা দিয়ে হয়রানি করছে।

দুই ছাত্রের অভিভাবক মো. আবু জাফর চৌধুরী ও সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ইন্টারনেটে এসেছে। পরীক্ষার্থীরাও মুঠোফোনে তা পেয়েছে। তারা তো তা ফাঁস করেনি।

গতকাল বেলা সোয়া ২টায় চট্টগ্রাম মহানগর শিশু আদালতে ১১ পরীক্ষার্থীকে নেওয়ার পর প্রথমে তাদের আসামিদের জন্য নির্ধারিত কাঠগড়ায় রাখা হয়। এক আইনজীবী এর প্রতিবাদ জানালে দায়িত্বরত পুলিশের সদস্যরা তাদের কাঠগড়ার বাইরে নিয়ে আসেন। শুনানি শুরু হওয়ার পর বেলা সাড়ে তিনটায় বিচারক এজলাস থেকে নেমে ১১ শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের খাসকামরায় নিয়ে যান। সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলেন।

এর আগে শুনানির সময় ১১ শিক্ষার্থীদর চোখেমুখে ছিল চরম আতঙ্ক। অনেকের চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। ভয়ে অনেকে মাথা নিচু করে রাখেন।

আদালত প্রাঙ্গণে চারজন অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, বিচারক শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চেয়েছেন তারা কীভাবে এই প্রশ্নপত্র পেয়েছে।

শুনানি শুরুর আগে আদালত প্রাঙ্গণে এক অভিযুক্ত পরীক্ষার্থী প্রথম আলোর কাছে বলে, ফেসবুকে ‘সায়েম আহমেদ’ নামের একটি গ্রুপ থেকে তাকে এসএসসি প্রশ্ন নেওয়ার জন্য মেসেজ দেয়। প্রশ্ন নিতে হলে বিকাশে প্রথমে ৩০০ টাকা পাঠাতে বলে। এই টাকা পাঠানোর পর তাকে গ্রুপে যুক্ত করে। এরপর পরীক্ষার দিন সকালে পরীক্ষা শুরুর এক থেকে দেড় ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র পাঠায়। প্রশ্নপত্র দেওয়ার পর আরও ৬০০ টাকা বিকাশে পাঠাতে হয়। এভাবে তারা ১১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ে বহুনির্বাচনী প্রশ্নপত্র (এমসিকিউ) পেয়েছে। যাদের কাছ থেকে প্রশ্ন পেয়েছে তাঁদের কাউকে চেনে না বলে জানায় সে। ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেই তাদের যোগাযোগ হয়।

গতকাল বিকেল পাঁচটার দিকে বিচারক আবার এজলাসে ওঠেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘একজন শিক্ষার্থীও সত্য বলেনি। শুধু একজন অভিভাবক কিছুটা সত্য বলেছেন। দেশটা আমরা কাদের হাতে রেখে যাব। আগামীতে তারাই দেশের হাল ধরবে।’ পরে বিচারক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সনজয় কুমার সিনহাকে ১১ শিক্ষার্থীকে আদালতে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন। যাতে প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রটি শনাক্ত হয়। বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত তদন্ত কর্মকর্তা ১১ শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।