Thank you for trying Sticky AMP!!

'বয়সটয়স নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নাই'

দ্বিজেন শর্মা

দুপুরের একটু পর যখন তাঁর সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িতে পৌঁছালাম, তখন দ্বিজেন শর্মা ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মশিউল আলম আর আমাকে দেখে উঠে বসলেন তিনি, মুখে ভুবনমোহিনী হাসি। ফুল আর বইগুলো একপাশে রেখে বললেন, ‘কেমন আছিস তোরা?’
সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষের শুরু যখন, তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে আমাদের সখ্য। মস্কোতে থাকতেন তিনি, তাই মশিউলের সঙ্গে দারুণ ভাব। ক্রাসনাদার থেকে মস্কো এলে আমিও তাঁর সঙ্গ পেতাম। একবার আমাদের শহরে গিয়ে বলে এসেছিলেন, এক্সঝুপেরির ‘লিটল প্রিন্স’টা যেন অনুবাদ করে ফেলি। কথা রেখেছিলাম।
২৯ মে তাঁর জন্মদিন। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে গেছি আমরা দুজন। এদিন তিনি আটাশিতে পড়লেন। বাড়িতে তখন তিনি আর দেবী শর্মা। সন্ধ্যায় অনেকে আসবেন, তার প্রস্তুতিও চলছিল।
সুযোগ পাওয়ায় একটু বড়লেখার কথা জানতে চাই। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলা—এখান থেকেই জীবনের শুরু তাঁর। স্মৃতিতে বড়লেখার ছাপ মোটেই ছোট নয়। জানালেন, কলকাতায় পড়াশোনা করার সময় বার তিনেক টেক্সট বই বিক্রি করে শিয়ালদা থেকে ট্রেনে করে বাড়ি চলে এসেছিলেন। এই রেললাইনটা তাঁর মনকে উদাস করে দিত। তাই কলকাতা-বড়লেখার যাতায়াত শুধু ছুটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না।
হারিয়ে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে দ্বিজেন শর্মার স্মৃতিকাতরতায় আমরাও আবেগতাড়িত হই। তিনি বলছিলেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন—এ রকম দেশ পৃথিবীতে কোনো দিন ছিল না, ভবিষ্যতেও হবে না। এমন এক অদ্ভুত দেশ, আমি গিয়ে তো অবাক হলাম যে সব মানুষই প্রায় সমান। কে ইঞ্জিনিয়ার, কে ডাক্তার, কে প্রফেসর, কে শ্রমিক, তা বোঝা যায় না। বাড়িঘর সবার এক, দোকানে সবাই কিউয়ে দাঁড়িয়ে কেনাকাটা করে—এমন দেশ তুমি পাবে কোথায়? এক রুবল পকেটে নিয়ে তুমি স্বস্তিতে সারা দিন ঘুরতে পার। টাকাপয়সার অভাব তোমাকে বিন্দুমাত্র তাড়িত করবে না, এসব অভিজ্ঞতা ওই সমাজতন্ত্র ছাড়া আর কোথাও হয় না।’

এরপর বললেন, ‘থাকল না। তার কারণ মানুষের যে প্রকৃতি, তা ভীষণ গোলমেলে। ধর্ম ও সংস্কৃতি মানুষকে উন্নত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু মানুষ সেসব জিনিস কিছুই গ্রহণ করে না। জন্মের পর থেকে মানুষ কত নীতিবাক্য শুনেছে, কিন্তু মানেনি। এটা মানুষের অন্তর্গত সমস্যা।’
তাঁর ঘুমের সময়টা মাটি করতে চাই না, তাই আমরা উঠে পড়ি। ফিরছি যখন, তখন তিনি বলছিলেন, ‘এখনো বই পড়ছি। প্রচুর পড়ি। মাঝেমাঝে লিখি। আর শোনো, বয়সটয়স নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নাই। তবে অসুখ হলে একটু খারাপ লাগে।’
এই প্রকৃতিবিদ, বিজ্ঞানলেখক, শিক্ষকের কাছাকাছি হয়ে মনে হলো, ইশ্‌, এ রকম মানুষ দিন দিন কমে যাচ্ছে! কাছে গেলে তাঁর ভেতরের আলো এসে আলোকিত করে দেয় চারপাশ।
ভালো থাকুন দ্বিজেন শর্মা। আরও বহুদিন আমাদের আলোকিত করুন।