Thank you for trying Sticky AMP!!

'ভাবতেই পারিনি, গুলি চলতে পারে'

ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক (বাঁয়ে) ও সাঈদ হায়দার (বাঁ থেকে দ্বিতীয়) ভাষাসংগ্রামের গল্প শোনাচ্ছেন এই প্রজন্মের পাঁচ তরুণ ও তরুণীকে। ১২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে। ছবি: হাসান রাজা

শহীদ মিনারে পৌঁছোতে পৌঁছোতে শীতদুপুর বিকেলের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। রোদের তেজি ভাব নেই। কিন্তু সেখানে নামতে না নামতেই ঝলমলে সতেজ ভাব চলে এসেছে সাঈদ হায়দার আর আহমদ রফিকের অবয়বে। বায়ান্নর সেই প্রখর বিদ্রোহ–দিনের আলো যেন ঠিকরে পড়েছে তাঁদের মুখে। এমনিতে শরীর ভালো নেই দুজনারই। বায়ান্নর পর ৬৮ বছর ধরে পানি বয়ে গেছে বুড়িগঙ্গায়। সাঈদ হায়দারের বয়স এখন ৯৪ বছর, আহমদ রফিকের ৯১। কিন্তু শহীদ মিনারের সামনে এসে শরীর থেকে যেন বয়স ঝরে গেছে।

গান ভেসে আসছে মিনারের বেদি থেকে। ভাষার গান। সার বেঁধে গান গাইছেন কোনো সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সাদা–কালো ডুরে শাড়ি পরা সদস্যরা। চারদিকে একুশের আবহ।

সাঈদ হায়দার আর আহমদ রফিকের সঙ্গে আজ গল্প করতে এসেছে পাঁচজন তরুণ–তরুণী। ওদের কেউ পড়ে বাংলা বা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে, কেউ মাদ্রাসায়। এই দুজনের সঙ্গে গল্পে গল্পে ভাষা আন্দোলনের উত্তেজনাভরা দিনগুলোর অনুভূতি নিজের মধ্যে পেতে চায় তারা। বুঝতে চায়, তাদেরই কাছাকাছি বয়সের ছেলেমেয়েদের বুকে একদিন ভাষার প্রতি কী এমন মমতা জেগে উঠেছিল যে জীবন পর্যন্ত বাজি রেখেছিল তারা।

মৃন্ময়ী গুহ আর আদিয়ান আতিক কিছুদিন পর এ–লেভেল দেবে। মৃন্ময়ী সানিডেইল আর আদিয়ান সানবিমস থেকে। তাসফিয়া কাদের আফরা, সরদার আকিব লতিফ আর ওবায়দুল্লাহ
 সায়াদ পড়ে দশম শ্রেণিতে। তাসফিয়া হলি ক্রসে, আকিব লতিফ ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে আর ওবায়দুল্লাহ তাহফিজুল কুরআনিল কারিম ফাজিল মাদ্রাসায়।

সাঈদ হায়দার আর আহমদ রফিকের কাছে ভাষা আন্দোলনের দিনগুলো নিছক স্মৃতি নয়, জীবন পাল্টে দেওয়া ঘটনা। তাঁদের গল্পে সজীব হয়ে ফিরে এল সেসব দিনের ঘটনাপ্রবাহ। ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁরা অন্য ছাত্রদের সঙ্গে ঢাকার রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। তাঁদের মুখে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি। হৃৎপিণ্ড জ্বলন্ত বারুদে ঠাসা। সাঈদ হায়দার আর আহমদ রফিক তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। ভাষা আন্দোলনের সময় তাঁরা রাজপথে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে বায়ান্নর ২৩ ফেব্রুয়ারিতে কারফিউর রাতে হাত লাগিয়েছেন একুশের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তুলতে। আন্দোলনে যুক্ত হওয়ায় বরখাস্ত হয়ে দুই বছর মেডিকেল কলেজে পড়তে পারেননি আহমদ রফিক। সেই শাস্তি এখন তাঁর গৌরব। ভাষাশহীদদের রক্তের মধ্য দিয়ে যে বাঙালি নতুন করে চিনল তার জাতিকে। সেই থেকে বাঙালির নতুন পথচলারও শুরু।

দুই প্রজন্মের আলাপে জীবন্ত হয়ে ওঠে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
সাজ্জাদ শরিফ: অমর একুশে সামনে রেখে আহমদ রফিক আর সাঈদ হায়দারকে আমরা শ্রদ্ধা জানাই। আপনারা ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। আপনাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার জন্য পাঁচজন তরুণ ছাত্রছাত্রী এসেছে। ১৯৫২ সালে জাতি হিসেবে বাঙালি প্রবল এক বিস্ফোরণে নিজেদের প্রকাশ করল। সে তো বিরাট ইতিহাস। এ নিয়ে আপনাদের সঙ্গে এই তরুণেরা কথা বলবে, গল্প করবে।

আদিয়ান আতিক: ১৯৫২ সালের সময়টা আমরা জানি না। কেমন ছিল সে সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়?

সাঈদ হায়দার: এখন যে রকম, তখন তো এমন ছিল না। এখন যেটা ঢাকা মেডিকেল কলেজ ভবন, তার একটি অংশ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। আরেক অংশ ছিল মেডিকেল কলেজ।

আহমদ রফিক: তোমরা কি জানো এই হাসপাতাল ভবনের বয়স কত? ১১৫ বছর। কার্জন হল যাঁর নামে, তিনি ছিলেন ভাইসরয়। বাংলায় অনেক গন্ডগোল হয় বলে তিনি বললেন, পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ ভাগ করে দাও। পূর্ববঙ্গের সঙ্গে আসামকে যুক্ত করে নতুন প্রদেশ হলো। তার রাজধানী হলো ঢাকা। তার জন্য সচিবালয় হলো। কার্জন হল ও পুরোনো হাইকোর্ট সে সময়ের। কার্জন হলের লাল দালানগুলোই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। হাসপাতালের সামান্য একটা অংশ নিয়ে ছিল আর্টস বিল্ডিং। এখন এটা মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সি কমপ্লেক্স। এখানে একটা বড় আমগাছ ছিল। সেটাই ঐতিহাসিক আমতলা।

আদিয়ান আতিক: বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটা তখন কেমন ছিল?

আহমদ রফিক: তখন সব খালি। ফুলার রোডের পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের থাকার জায়গা ছিল। শহীদ মিনার নির্মাণের সময় সেসব ভেঙে ফেলা হয়।

মৃন্ময়ী গুহ: ভাষা আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ কেমন ছিল? যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, সবাই কি মেডিকেল কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন?

সাঈদ হায়দার: সবাই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তা তো নয়। ৩০ থেকে ৪০ জন মেয়ে ছিল। মেয়েদের মিছিল ছিল আলাদা।

আহমদ রফিক: মেয়েরা সংখ্যায় কম হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা সংখ্যায় ছিল বেশি। পরিচিত নামগুলো হলো শরীফা খাতুন, হালিমা খাতুন, ফাতেমা বেগম, রওশন আরা বাচ্চু, সুফিয়া আহমেদ প্রমুখ। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল কামরুন নেসা স্কুলের ছাত্রীরাও।

তাসফিয়া কাদের আফরা: তাঁরা কি সকাল থেকেই ছিলেন?

আহমদ রফিক: সকাল ১০টা–১১টা থেকেই তাঁরা ছিলেন। খুব সংক্ষিপ্ত সময়ে সভা শেষ করে সবার উদ্দেশ্য ছিল জগন্নাথ হলে যাওয়া। তখন সেটা ছিল আইন পরিষদ ভবন। সেদিন বেলা তিনটায় বাজেট অধিবেশন ছিল। তখনো পূর্ব পাকিস্তান নাম হয়নি। নাম ছিল পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপনা পরিষদ বা আইনসভা। এখন যেটা মেডিকেল কলেজের আউটডোর আর ডিসপেন্সারি বিল্ডিং, তার পাশে বিরাট জায়গা নিয়ে ছিল নার্সদের কোয়ার্টার। এসব জায়গাতেই মেডিকেল ব্যারাক ছিল। ২০টা ব্যারাকের মধ্যে প্রথম ১৭টা ছিল বাঁশের। শেষ তিনটায় ছিল পাকা মেঝে, বাঁশের বেড়া, টিনের ছাউনি।

সরদার আকিব লতিফ: আমতলায় যে সভা হয়েছিল, তাতে ছাত্রছাত্রীরা তো এসেছিলই। সাধারণ মানুষের আগ্রহ কেমন ছিল?

আহমদ রফিক: ২০ তারিখ রাতে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভা হয়। এ সভায় মাওলানা ভাসানী অনুপস্থিত থাকায় আবুল হাশিম সভাপতিত্ব করলেন। সভায় রাজনীতিকেরা বললেন, ১৪৪ ধারা ভাঙা যাবে না। ঢাকা মেডিকেল ছাত্র ইউনিয়নের ভিপি গোলাম মওলা, যুবলীগের অলি আহাদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মতিন—এই তিনজন ভোট দিলেন ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে। ১১–৩ ভোটে তাঁরা হেরে গেলেন। কিন্তু তাঁরা বললেন, আমরা ছাত্রদের এটা বোঝাতে পারব না। পরদিন ২১ তারিখ সকালে ছাত্রদের একটা সভা হলো। সেখানে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলের ছাত্রছাত্রী। সেখানে সিদ্ধান্ত হলো যেকোনো মূল্যে ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে। আবদুস সামাদ আজাদ প্রস্তাব দিলেন, দশজন দশজন করে মিছিল করতে হবে। তাঁর এ প্রস্তাব গৃহীত হলো। সেই হিসেবেই আর্টস বিল্ডিংয়ের গেট দিয়ে দশজন দশজন করে বেরিয়ে যাওয়া হয়। এখন সে গেটটি বন্ধ।

সাঈদ হায়দার: সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ২০ ফেব্রুয়ারির সভার সিদ্ধান্ত মানা হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছিল ছাত্র প্রতিনিধিরা। সভাপতি আবুল হাশিম মত দিয়েছিলেন, সভার সিদ্ধান্ত না মানা হলে এ কমিটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

ওবায়দুল্লাহ সায়াদ: সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কবে গঠিত হয়েছিল?

আহমদ রফিক: পুরান ঢাকার বার লাইব্রেরিতে ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি একটি কর্মিসভা হয়েছিল। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, প্রতিটি সংগঠন থেকে দুজন দুজন করে নিয়ে ৪০ জনের একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হবে। কাজী গোলাম মাহবুব তার আহ্বায়ক হয়েছিলেন। সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম।

আদিয়ান আতিক: ছাত্ররা কি জানতেন যে সংগ্রাম পরিষদের আদেশ অমান্য করে তাঁরা সফল হতে পারবেন?

আহমদ রফিক: সফলতা–বিফলতার কোনো প্রশ্নই ছিল না। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল, আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙব। ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী কর্মসূচি পালন করা হবে। সভা–সমাবেশ থেকে শুরু করে হরতাল সবই করা হবে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ আমাদেরই করা। তবু পরদিন আমতলায় ছাত্রসভা ডাকা হলো। ছাত্ররা এত উত্তেজিত ছিল যে তারা সময় নষ্ট করতে রাজি ছিল না।

তাসফিয়া কাদের আফরা: ছাত্ররা কি পরিষদ ভবন পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলেন?

আহমদ রফিক: ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আইন পরিষদের সদস্যদের শপথ নেওয়াবে, তারা যেন বাজেট অধিবেশনে সিদ্ধান্ত নেয় যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করা হবে। এটা পরিষদে পাস করিয়ে নিতে হবে। কিন্তু ছাত্ররা পরিষদ ভবন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। ব্যারিকেড দেওয়া হলো, কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হলো। মেডিকেল প্রাঙ্গণে বাইরের মানুষ পাঁচজন–দশজন করে জমা হতে লাগল। বাইরের মানুষ যদি না–ই আসত, তাহলে সচিবালয়ের পিয়ন আবদুস সালাম গুলিবিদ্ধ হলেন কী করে? বেলা যত বেড়েছে, লোকজনও ততই বেড়েছে।

মৃন্ময়ী গুহ: গুলি চলার পর আপনারা কী করলেন?

আহমদ রফিক: ১২টার পর থেকেই সমাবেশে লোক বাড়ছে। তখন মেডিকেলের গেট খোলা। কিছু ছেলে ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করছে। আর পুলিশের লাঠিচার্জের মুখে ফেরত আসছে। এই করতে করতে বেলা তিনটা। এদিকে রাস্তায় অনেক মানুষ জমা হয়ে গেছে। এর মধ্যেই ৩টা ২০ মিনিটে গুলি চলল। মেডিকেল ছাত্র ইউনিয়নের একটা মাইক ছিল। জগন্নাথ হলের দিকে মুখ করে, আমগাছে। মাইকে ক্রমাগত স্লোগান চলছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।

মৃন্ময়ী গুহ: আপনারা কি ভেবেছিলেন যে গুলি চলতে পারে?

আহমদ রফিক: প্রথম গুলি চলার পরে আমাদের বন্ধু মোশাররফ চিৎকার করে উঠল, ফাঁকা গুলি, ফাঁকা গুলি। আমরা ভাবতেই পারিনি, গুলি চলতে পারে। পরে সরকারের নিয়োগ করা এলিস কমিশন চারজন ছাত্রকে ডেকে নিয়েছিল গুলি চালনা সংগত হয়েছিল কি না, তা জানার জন্য। তাদের একজন ব্রিগেডিয়ার আবদুল মালেক। আমার সহপাঠী বন্ধু, অরাজনৈতিক। আন্দোলনে সমর্থন ছিল, কিন্তু সরাসরি জড়িত ছিল না। ওকেসহ চারজন অরাজনৈতিক ছাত্রকে কমিশন নিয়ে গেল। তারা বলেছিল, গুলি করা ঠিক ছিল না। কমিশন এটাকে তাদের প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করেনি। আজ তোমাদের বলি, এই গুলির পেছনে শুধু যে অবাঙালি অ্যাডিশনাল সিটি এসপি মাসুদ বা ম্যাজিস্ট্রেট কোরায়শীর দোষ ছিল না। বাঙালি পুলিশ কর্মকর্তা এ জেড এম ওবায়দুল্লাহ, সিটি এসপি মোহাম্মদ ইদ্রিস এদেরও মতামত নিয়ে গুলি চালানো হয়েছিল। বাঙালিদের মধ্যেও বিশ্বাসঘাতক কম ছিল না।

সরদার আকিব লতিফ: আবুল বরকত কি প্রথম শহীদ?

আহমদ রফিক: প্রথম শহীদ রফিক উদ্দিন। তাঁর মাথায় গুলি লেগেছিল। দুই নম্বর শহীদ আবদুল জব্বার, ইমার্জেন্সিতে নেওয়ার পর তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তিন নম্বর শহীদ আবুল বরকত। অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার পর রাত আটটায় তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হলো। সালাম মারা গেলেন চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ এপ্রিল।

আদিয়ান আতিক: ২১ ফেব্রুয়ারির দিনটা কীভাবে শেষ হলো?

আহমদ রফিক: ২১ তারিখে গুলিবর্ষণের পর একটা শোকাবহ স্তব্ধতা। শহীদদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। সবাই ব্যস্ত। দৌড়াদৌড়ি করছে। সেবার ফেব্রুয়ারিতে অসম্ভব শীত। পুরান ঢাকা থেকে এত মানুষ এল যে পায়ের ধুলায় চারদিক কুয়াশার মতো হয়ে গিয়েছিল। সবার মুখে মুখে ছিল, ‘পুলিশ গুলি কইরা ছাত্র মাইরা ফালাইছে।’ এত বিরাট প্রতিক্রিয়া যে বলে বোঝানো যাবে না। তবে বলি, পুলিশ গুলি না চালালে হয়তো ২১ ফেব্রুয়ারি হতো না।

মৃন্ময়ী গুহ: তারপর দিন কী হলো?

সাঈদ হায়দার: গায়েবানা জানাজা হলো। তাতে অংশ নিল পাঁচ থেকে ছয় হাজার মানুষ। আগেই স্লোগান উঠেছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’। এবার শোনা গেল, ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। এতে স্মৃতিস্তম্ভের বিষয়টি চলে এল। মেডিকেল ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি ছিলেন গোলাম মওলা। সাধারণ সম্পাদক শরফুদ্দিন আহমদ। তখন চাইলেই সিমেন্ট পাওয়া যেত না। ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাজের জন্য পিয়ারু সরদারের কাছে নির্মাণসামগ্রী ছিল। তিনি চাবি তুলে দিলেন। আমাদের বন্ধু বদরুল আলম নকশা করেছিল। বদরুল আর আমি একই রুমে থাকতাম। পোস্টার লিখতাম। বদরুলের নকশায় কংক্রিটের ব্যাপার ছিল। আমার এ বিষয়ে কিছুটা ধারণা ছিল। সেভাবেই নকশা করা হলো। রাতের মধ্যেই শেষ করতে হবে। তখন কারফিউ। ২৩ তারিখ রাতে এটা হলো। স্মৃতিস্তম্ভের খবর শহরে ছড়িয়ে গেল। ২৪ তারিখ বহু মানুষ এটা দেখতে এল।

তাসফিয়া কাদের আফরা: আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে ছাত্রছাত্রীদের পরে কিছু হয়নি?

আহমদ রফিক: আজাদসহ অন্যান্য পত্রিকার রিপোর্টের কারণে গ্রাম এলাকার স্কুল–কলেজেও আন্দোলন শুরু হলো। আবুল হোসেন নামে চাটমোহরের একজন ছাত্র ছিল সংগ্রাম কমিটির সভাপতি। আন্দোলন করার ফলে স্কুল থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়। তার জীবনটা তো শেষ। মেহেরপুরের মহকুমা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র নাজির হোসেন। পরশু তার ছেলে ফোন করে বলল, বাবা বেঁচে নেই। আমি কোথাও তাঁর কথা লিখব কি না। নাজির হোসেনের তবু কিছু জমিজমা ছিল। কোনোমতে চলে গেছে। আবুল হোসেনের কিছুই ছিল না। এদের ক্ষতিপূরণ কে দেবে?

নেতারা বলেন, ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে ঊনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা। স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁদের কী দিয়েছে? এ প্রশ্ন আমার সবার কাছে।