Thank you for trying Sticky AMP!!

বাঘাইছড়ি উপজেলা বঙ্গলতলী ইউনিয়নের বালুখালী গ্রামের নিহত ইউপিডিএফের সদস্য নিপন চাকমা দুই সন্তানসহ স্ত্রী নিলা চাকমা

যে লড়াই কেবল নিলা, মিনু ও এশিয়া চাকমাদের

দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলছে ভ্রাতৃঘাতী লড়াই। পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করে ১৯৯৮ সালে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) থেকে এক দল নেতা-কর্মী বেরিয়ে গঠন করেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)।

এরপর থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ ও হানাহানি শুরু হয়। এরপর জেএসএস ভেঙে জেএসএস-এমএন লারমা এবং ইউপিডিএফ ভেঙে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক গঠিত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাত নতুন মাত্রা পায়। গত আট বছরে শুধু রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় চার আঞ্চলিক দলের ১১৯ জন খুন হন ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে।

ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে নিহত নেতা-কর্মীদের পরিবারে নেমে আসা দুর্ভোগের কথা অনেকেরই অজানা। পাহাড়ের তিন জেলায় ছড়িয়ে থাকা এসব পরিবারের নারীরা স্বামী হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন।

এমন নারীদের একজন রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার বঙ্গলতলী ইউনিয়নের বালুখালী গ্রামের নিলা চাকমা। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টার দিকে বঙ্গলতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে এক কনসার্ট অনুষ্ঠানে নিলার স্বামী ইউপিডিএফের সদস্য নিপন চাকমা (৩৫) প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন। স্বামীর মৃত্যুর পর দুই সন্তানকে নিয়ে কী করবেন, বুঝতে পারছেন না নিলা। স্বামীই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। মেয়ে রিনিশা চাকমা মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ও ছেলে জসলিন চাকমা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। তাদের লেখাপড়া এখন অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি নিলা চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘কীভাবে দুই সন্তানকে লেখাপড়া শেখাব, বড় করে তুলব, জানি না। আমাদের চোখের সামনে এখন শুধুই অন্ধকার।’

বাঘাইছড়ির সাজেক ইউনিয়নের বাঘাইহাট-সাজেক সড়কের মাচালং ব্রিজপাড়ায় একই সঙ্গে প্রতিপক্ষের গুলিতে মারা যান ইউপিডিএফের সদস্য আশীষ চাকমা (৪০) ও দীপায়ন চাকমা (৩৫)। সাজেক ইউনিয়নের মাচালং বাজার এলাকায় দীপুপাড়ায় দীপায়ন চাকমা স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী এশিয়া চাকমা দুই সন্তান নিয়ে আপাতত বাবা উত্তম মঙ্গল চাকমার কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এশিয়া চাকমা। তাঁর বড় ছেলে অর্বিল চাকমা ষষ্ঠ শ্রেণি ও ছোট মেয়ে চাঁদনী চাকমা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। স্বামীর মৃত্যুর পর দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ কে দেবে, জানেন না তিনি।

এশিয়া চাকমার বাবা উত্তম মঙ্গল চাকমা বলেন, ‘দুই নাতনিসহ আমার মেয়ে এশিয়া চাকমা আপাতত আমার কাছে আশ্রয় নিয়েছে। আমিও তেমন কিছু করি না। অভাবে টানাটানির সংসার, তা ছাড়া আমি অসুস্থ, কাজ করতে পারি না। যত দিন থাকতে পারে থাকুক তারা। পরে কী হবে জানি না।’

বাঘাইছড়ির রূপকারী ইউনিয়নের মগবান মোরঘোনা গ্রামে থাকতেন খুন হওয়া আশীষ চাকমা। তাঁর দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে সোহেল চাকমা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও ছোট ছেলে আয়মন চাকমা একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। আশীষ চাকমা মারা যাওয়ার পর দুই সন্তান নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে পরিবারটি। আশীষ চাকমার স্ত্রী মিনু চাকমা বলেন, ‘দুই সন্তানকে নিয়ে কী করব কিছু বুঝতে পারছি না। বড় ছেলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তার সঙ্গে সব সময় থাকতে হয়। খাবারও খাইয়ে দিতে হয়। ছোট ছেলের কলেজে পড়ার খরচ কে দেবে জানি না। মনে হচ্ছে ওদের বাবা না মরে আমি মরে গেলে ভালো হতো।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নতুন দল আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত শুরু হয়। অপর দুই আঞ্চলিক জেএসএস (এমএন লারমা) ও জেএসএস-সন্তু লারমাও এই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। গত আট বছরে শুধু রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় চার আঞ্চলিক দলের ১১৯ জন খুন হন। এ ছাড়া দুর্গম জঙ্গলে আট বছরে ২০ থেকে ৩০ বার বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ হয়। এ ছাড়া সংঘাতে অসংখ্য নেতা-কর্মী পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।

সাজেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অতুলাল চাকমা বলেন, সম্প্রতি সাজেকে দুই ইউপিডিএফ সদস্য মারা যাওয়ার পর পরিবার দুটো অসহায় হয়ে পড়েছে। দুই পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ। সন্তানদের পড়াশোনার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শুধু দুই ইউপিডিএফের সদস্য নয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে বহু মানুষ বাবা ও স্বামী হারিয়ে পথে বসেছে।