Thank you for trying Sticky AMP!!

স্বজনের খোঁজে বাংলাদেশে আসা আশা ওয়েলস। ১১ মার্চ দুপুরে প্রথম আলোর কার্যালয়ে

কেটে গেল ৫০ বছর, স্বজনের দেখা কি পাবেন আশা

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশ থেকে ডেনমার্কে দত্তক সন্তান হিসেবে যাওয়ার সময় আশার সিরিয়াল নম্বর ছিল ১৬৯। এ তথ্য আশা প্রথম জানলেন নিজের ৫০ বছর বয়সে এসে।

১০ মার্চ দুপুরে রাজধানীর ইসলামপুর রোডে অবস্থিত মাদার তেরেজ শিশু ভবনের পুরোনো দলিল খুঁজে বের করেছেন আশা। এ জন্য তাঁকে ডেনমার্ক থেকে দেশে আসতে হয়েছে।

দলিলে লেখা আছে, ১৯৭৫ সালে ছোট্ট আশাকে খুলনার একটি ক্যাথলিক অনাথ আশ্রমে রেখে এসেছিলেন ডলি মণ্ডল নামের একজন নারী। আশাকে পাওয়া গিয়েছিল খুলনা রেলস্টেশন রোডে। এটুকু ছাড়া আশা নিজের জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে কিছুই জানেন না। জন্মদাতা মা–বাবা সম্পর্কে কোনো খবর নেই তাঁর কাছে। কিন্তু তাঁদের খুঁজতেই ৯ মার্চ আবার বাংলাদেশে এসেছেন ডেনমার্কের নাগরিক আশা ওয়েলস। এর আগে ২০০৪ সালে একবার এসেছিলেন, কিন্তু লাভ হয়নি। এবার একটু একটু করে হারানো সূত্রের সংযোগ করছেন আশা।

ডেনমার্কে নিয়ে যাওয়ার পরপরই তোলা হয় শিশু আশার এই ছবি

আগামীকাল বুধবার আশা যাবেন খুলনার সেই অনাথ আশ্রমে। এর আগে ১১ মার্চ দুপুরে প্রথম আলোর কারওয়ান বাজার কার্যালয়ে বসে তিনি বললেন, ‘হারিয়ে গিয়েছিলাম, নাকি আমাকে ফেলে যাওয়া হয়েছিল, নাকি পাচার হয়েছিলাম—সেই সত্যিটাই জানি না।’ তিনি বলেন, ‘নথিপত্রে আমার জন্ম তারিখ, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪। এই তথ্যের ভিত্তি কী? তবুও যদি ওই তারিখই ধরি তাহলে ডলি মণ্ডল নামের নারী আমাকে পেয়েছেন দেড় বছর বয়সে। এই বয়সের শিশুকে ফেলে যাওয়ার কথা নয়। হারিয়ে গেলে মা–বাবা হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করে আছেন।’

প্রশ্নের শুরু মা হওয়ার সময় থেকে

যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশ থেকে ১৯৭৬ সালে ডেনমার্কের মিস্টার অ্যান্ড মিসেস পেডারসন নামে এক দম্পতির পরিবারে দত্তক হয়ে গিয়েছেন আশা। তখন থেকে তাঁর নাম আশা ওয়েলস। আশা ওয়েলসের ছেলের বয়স এখন ২০ বছর। মেয়ে ১৭ বছর। ২০০৪ সালে যখন দেশে এসেছিলেন, তখন আশার সঙ্গী হয়েছিল ছেলেটা।

১৯৭৬ সালে দত্তক হিসেবে পেডারসন দম্পতির সঙ্গে আশার ডেনমার্ক যেতে বাধা নেই লেখা সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনুমতিপত্রে

নিজের স্বজনদের খুঁজে বের করতে আশার এ যাত্রা শুরু হয়েছিল ছেলের জন্মের সময় থেকে। ডেনমার্কের হাসপাতালের চিকিৎসকেরা আশাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, পারিবারিকভাবে কোন কোন ধরনের অসুখ আছে তাঁর? তখন আশার বয়স ৩০ বছর। তখনই আশার প্রবলভাবে মনে হয়েছে, পেডারসন দম্পতি তাঁকে নিজের সন্তানের মতো যত্নে বড় করেছেন। কিন্তু মানুষের রক্তের সম্পর্কীয় স্বজনদের চেনা–জানাটা সমানভাবে জরুরি।

নানাভাবে শুরু হয় আশার শিকড় সন্ধানের যাত্রা। শুরুতে তিনি বাংলাদেশ থেকে ১৯৮১ সালে নেদারল্যান্ডসে দত্তক নেওয়া অ্যালেডিস গোডো নামের আরেক নারীর সঙ্গে ডিএনএ পরীক্ষা করান। এতে দেখা যায় বাংলাদেশ থেকে দত্তক নেওয়া এ দুই শিশুর মধ্যে পাঁচ প্রজন্ম আগে সম্পর্ক ছিল। তবে এ ব্যাপারে নরওয়ের অ্যালেডিস বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না বলে জানালেন আশা।

এরপর আশা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে দত্তক শিশু হিসেবে যাওয়া মানুষের সংগঠনে যুক্ত হন। চলতে থাকে তাঁর শিকড় সন্ধানের যাত্রা।

ডেনমার্কে আশার জীবন

পেডারসন দম্পতি আশাকে দত্তক নেওয়ার পাঁচ বছর পর তাদের একটি ছেলে সন্তান হয়। তাঁর সঙ্গে আপন ভাইবোনের মতোই বড় হয়েছেন আশা। তবে ছোটবেলা থেকেই নিজের বাদামি রঙের জন্য আশা বুঝতেন, তিনি আশপাশের অন্য শিশুদের থেকে কোথাও আলাদা। ছোটবেলাতেই তাঁকে তাঁর মা–বাবা জানিয়ে দিয়েছেন সত্যিটা।

স্কুল–কলেজে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হননি বলে জানালেন আশা। ১৪ বছর বয়সে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাপ্টিস্ট করা (খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা) হয় তাঁকে। প্রথম আলোকে আশা বলছিলেন, ‘কোন ধর্মের হয়ে আমি জন্মেছি, সেই সত্যিটাও জানি না। সবাই বলে তুমি তো ভালো পরিবারে দত্তক হিসেবে গেছ। তোমার ভাগ্য বদলে গেছে। কিন্তু নিজের সত্য পরিচয়ের কিছুই না জানা কেমন মানসিক অশান্তির, এটা অন্যরা বুঝবে না।’

আশা ওয়েলস এখন ডেনমার্কে কাজ করেন স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে। তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছেন স্বামী মগ্যান ফোক। মগ্যান প্রথম আলোকে বললেন, ‘আপনাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের পরপর যেমন অনেক যুদ্ধশিশুকে দত্তক দেওয়া হয়েছে, তেমনি শিশু পাচারের ঘটনাও ঘটেছে। দেড় বছরের শিশু পাচার হতেই পারে। আশার তখন ওই রকম বয়সই ছিল। তাই সত্যি জানাটা খুব জরুরি।’

প্রথম আলো কার্যালয়ে আশার সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর স্বামী মগ্যান ফোক, ১১ মার্চ দুপুরে

পাচারের আশঙ্কা আশার

১৯৭৬ সালের ১ জুলাই সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে আশাকে দত্তক নেওয়ার অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়। ১ জুলাই ১৯৭৬ সালে দেওয়া এই পত্রে উল্লেখ রয়েছে, শিশু পুনর্বাসনসংক্রান্ত ১৯৭২ সালে প্রণীত বিশেষ আইনের আওতায় ডেনমার্কের পেডারসন দম্পতির কাছে আশাকে দত্তক হিসেবে দিতে কোনো বাধা নেই এবং তারা তাঁকে দেশটিতে নিয়ে যেতে পারবেন।

ডেনমার্কে নেওয়ার আগে রাজধানীর ইসলামপুরের শিশু ভবন থেকে আশাকে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এর আগে আশাকে খুলনায় কীভাবে পাওয়া যায়, সেই ব্যাপারটি অস্পষ্ট। নথিতে তাঁকে ডলি মণ্ডল রেখে গেছেন বলে উল্লেখ থাকলেও সেই নারীর নাম আসলেই ডলি মণ্ডল এবং তিনি আশাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন কি না বা আশা নামটিই সত্যি কি না, খুলনার রেলস্টেশনে পাওয়া শিশুর অন্য নাম ছিল কি না—এমন নানা প্রশ্ন রয়েছে।

প্রসঙ্গত, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের গর্ভে জন্ম নেওয়া শিশুদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তাঁদের দত্তক দিতে ১৯৭২ সালে একটি বিশেষ আইন করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে শিশু পাচার বা ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনার প্রেক্ষাপটে ১৯৮২ সালে সরকার আইনটি বাতিল করে। সেটা বাতিল হওয়ার আগপর্যন্ত বহু পরিত্যক্ত শিশুকে ওই আইনের আওতায় দত্তক দেওয়া হয়েছে।

ওই সময়ে পাচারের ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে বাংলাদেশ পুলিশের নিরাপত্তা স্পেশাল ব্রাঞ্চ। এ প্রসঙ্গে গত ২৪ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে উল্লেখ রয়েছে, ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে অনেক শিশুকে তাদের মা–বাবার সম্মতি ছাড়া বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এ বিষয়ে দালিলিক প্রমাণ পাওয়া গেছে।

আশা ওয়েলসের মনেও দেখা দিয়েছে এমন সন্দেহ। এ জন্য তিনি এবারের বাংলাদেশ সফরে দেখা করবেন পুলিশের স্পেশাল সুপারিনটেনডেন্ট তাহসিন মাসরুফ হোসেনের সঙ্গে।

স্বজনের খোঁজে ২০০৪ সালে বাংলাদেশে এসে বিফল হয়েছিলেন আশা। নথিপত্র খুঁজতে এবার প্রথমেই ছুটে গেছেন রাজধানীর ইসলামপুরে মাদার তেরেজ শিশু ভবনে

১১ মার্চ বিকেলে যোগাযোগ করা হলে তাহসিন মাসরুফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই সময় পাচারের ঘটনায় অনেক পক্ষ জড়িত। আমরা বেশ কিছু তথ্য, দলিল পেয়েছি। তবে তদন্তের স্বার্থে বিস্তারিত এখনই প্রকাশ করা যাবে না। প্রায় ৫০ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার মূলে পৌঁছানো কঠিন।’

তিনি বলেন, ‘আশা ওয়েলস আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। মানবিক বিবেচনায় আমরা স্থানীয় (খুলনা) থানার সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে যতটুকু সম্ভব সহায়তা করার চেষ্টা করব।’

আশার সঙ্গে শৈশবে কী ঘটেছিল, তা অজানা। তবে তা যা–ই হোক, এখন যদি মা–বাবা বা স্বজনদের কাউকে খুঁজে পান, তাহলে কী করবেন, জানতে চাওয়া হয় আশার কাছে। জবাবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবেদন করলে দয়া করে উল্লেখ করবেন, আমার ডান কানের পেছনে একটা কাটা দাগ আছে, যেটা নাকি আমাকে দত্তক নেওয়ার আগেই ছিল। যদি কেউ অপেক্ষা করে থাকেন আমার জন্য, তাঁর হয়তো মনে পড়বে। এখন আমি নিজের মা–বাবাকে একবার দেখতে চাই। তাঁরা কেউ না থাকলে স্বজনদের খুঁজে বের করতে চাই। দেখা পেলে অনেকক্ষণ তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকব। প্রাণভরে দেখব, তারপর হাত ধরে গায়ের ঘ্রাণ নেব।’

Also Read: পরিবার জোটেনি ৩৯% শিশুর