Thank you for trying Sticky AMP!!

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জে সাঁওতাল হত্যা ও জমি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ করেন সাঁওতালরা। গত ৬ নভেম্বর তোলা ছবি

উন্নয়নকর্মীদের খুনেরও বিচার হোক

বাংলাদেশের সংবিধান বলছে, প্রত্যেক নাগরিক আইনের আশ্রয় নেওয়ার অবারিত সুযোগ পাবে। উন্নয়নকর্মীদের হত্যার ঘটনায় ভুক্তভোগীর পরিবার বিচার পেয়েছে, এমন নজির খুব কম।

শাসকেরা জমিদার ও তাঁদের লাঠিয়ালদের নাকি সাতটি পর্যন্ত খুনের আগাম অনুমতি দিয়ে রাখত। এসব খুনের জন্য তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হতো না। দাঁড়াতে হতো না আদালতের কাঠগড়ায়। তবে খুনের এই চর্চা ব্রিটিশ আসার আগেও এ দেশে ছিল।

আসলে কর্তৃত্বকে মজবুত করার জন্য রাজা–বাদশাদের আমলেও তাঁদের তাঁবেদার বা অনুগত চাকরবাকরদের পদমর্যাদা অনুযায়ী খুনখারাবি বা গুম–হত্যার লাইসেন্স দিয়ে রাখা হতো। তবে কে কয়টা গুম–খুন করতে পারবে, কাগজে–কলমে তার একটা সীমারেখা ছিল। এসবের চর্চা থেকেই বুঝি ‘সাত খুন মাফ’ কথাটা চালু হয়ে যায়।

বলা বাহুল্য, সাত সাতেই থেমে থাকে না। সাতের লাইসেন্স নিয়ে সাত শ বা সাত হাজার মানুষকে হাপিশ করে হত্যাকারীরা পার পেয়ে যেত। লাইসেন্স প্রদানকারীরা যত দিন তখতে তাউসে আসিন থাকতেন, তত দিন জল্লাদরা নির্বিঘ্নে খুন–গুম চালিয়ে যেত। তবে গদি ওলটালে খবর হতো কখনো–সখনো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তত দিনে বিচার চাওয়ার লোক থাকত না।

বিচার চাওয়ার লোক থাকলে কাজ হয়

একদিন না একদিন বিচার হবেই—এমন আশায় অনেকেই বুক বাঁধেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে রাষ্ট্রের মনের ও মানের রং বদলালে নথিতে চাপা পড়ে থাকা খুনের শুনানি শুরু হয়। আবার কখনো প্রায় অসম্ভব সৎ এবং পেশাদার কর্মকর্তার অবিরাম প্রচেষ্টায় মামলার জট খোলে। মামলার চাকা ঘোরে, নথিপত্র খুঁজে পাওয়া যায়। মোকদ্দমা তার প্রাণ ফিরে পায় ৩০ বছর পরও।

আমাদের প্রিয় সহপাঠী রেলের সাবেক চিকিৎসক ডা. গাউসের বোন সগিরা মোর্শেদ হত্যার বিচার আবার শুরু হয়েছে। খুনিরা ধরা পড়েছে। বিচার চলবে। আজ থেকে প্রায় ৩৪ বছর আগে ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই রমনা এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী সগিরা মোর্শেদ খুন হন।

তিনি তখন তাঁর মেয়েকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছিলেন। সগিরা মোর্শেদের স্বামী আবদুস ছালাম চৌধুরী প্রথম থেকেই লেগে ছিলেন, হাল ছাড়েননি ডা. গাউসরা। মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলমান।

Also Read: রাষ্ট্র থাকে অনেক দূরে, কে দাঁড়াবে ম্রোদের পাশে

নিচতলার উন্নয়নকর্মীদের মারলে কিছু হয় না!

এ দেশে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা নিয়মিত সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন, প্রাণ হারাচ্ছেন, খুন হচ্ছেন। কিন্তু দিনের শেষে বিচার পাচ্ছেন না। আধুনিক পরিভাষায় এঁদের বলা হয় উন্নয়নকর্মী। কেউ আরও ঘন করে আদুরে গলায় ডাকেন ‘চেঞ্জ এজেন্ট’ বা পরিবর্তক। ন্যায্য সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে চাকরির সুবাদে যুক্ত হওয়া গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা খুন হলে আদালত–পুলিশের পেছনে দিনের পর দিন ছোটাছুটির দম এঁদের পরিবারের থাকে না। যে সংস্থার হয়ে তাঁরা কাজ করতেন, একদিন তাদেরও উৎসাহে ভাটা পড়ে।

জয়কুড় নামের গ্রামটি তেমন চেনা ছিল না। ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের এক গণ্ডগ্রাম জয়কুড়। ২৪ বছরের তাজা যুবক কমলা কান্ত রায় কানু দিনদুপুরে খুন না হলে জয়কুড় গ্রামটা আমরা কেউ কোনো দিন চিনতাম না। মুখ ফসকে এ কথাটা বেরিয়ে যাওয়ার পর বুঝেছিলাম আমার বেয়াকুবি। কথাটা মাটিতে পড়তে দেয়নি। এটাই এখন সান্ত্বনা। ‘মরেছে মরুক গ্রামটাকে তো সবাই চিনল’। কথাটা খুব দুঃখের সঙ্গে বললেন সেদিন মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ভারতী রানী।

Also Read: দুই সাঁওতাল কৃষকের আত্মহত্যার দায় কে নেবে

প্রায় ১৩ বছর আগে ২০১২ সালের ৪ জুলাই খাসজমির বেআইনি দখলদারদের লাঠির প্রথম বাড়িটা পড়েছিল ভারতীর মাথায়। ভূমিহীন ভারতী মাটিতে লুটিয়ে পড়তে পড়তে যে জন্মের চিৎকার দিয়েছিলেন, সেটা শুনেই তাঁকে বাঁচাতে ছুটে এসেছিলেন আরেক ভূমিহীন কানু। কানু, ভারতীরা মিলে গড়ে তুলেছিলেন ভূমিহীনদের জনসংগঠন। সেই জনসংগঠন অনেক দেনদরবার করে সংগঠিত ১৭-১৮ জন ভূমিহীনের অনুকূলে খাসজমিতে বসবাসের বরাদ্দ পেয়েছিলেন।

জয়কুড় গ্রামের খতিয়ান নম্বর ৫, দাগ নম্বর ৬২৮–এর সেই জমি যারা এত দিন বেআইনিভাবে ভোগদখল করছিল, তারা কেন সহজে ছেড়ে দেবে? এ দেশে দখলদারেরা মামলা–হামলার পথই বেছে নেয়। মামলা থেকে জামিনে বেরিয়ে এলে ভূমিহীনদের ওপর শারীরিক হামলার পথ ধরে ভূমিদস্যুরা। প্রাণ হারান কানু। থানা-পুলিশ প্রশাসন সবাই বিচারের আশ্বাস দিয়েছিল। দিনাজপুর, রাজশাহী, ঢাকা থেকে মানুষের ঢল নেমেছিল পীরগঞ্জে।

খাসজমি বণ্টন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ফেস্টুন মিছিল মিটিং বক্তৃতায় ভেসেছে পীরগঞ্জ, কিন্তু ১৩ বছরেও বিচার হয়নি খুনের। কানুর নামে দিবস হয়েছে, কিন্তু তাঁদের আসামি করে প্রতিপক্ষের করা মিথ্যা মামলাগুলো এখনো চালু আছে। প্রতিবছর কানু হত্যা দিবস পালন আহ্বায়ক কমিটি আর আন্ত উপজেলা ভূমিহীন সমন্বয় পরিষদ কালো কাপড়ের ওপর সাদা অক্ষরে লেখে ‘কমলা কান্ত কানু হত্যাকারী ভূমিদস্যুদের অবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই’। ব্যস, ওই পর্যন্ত। এটা এখন মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আরেকটি বিবৃতি দিবস মাত্র।

বিচার না হোক, কানুর লাশটা যে পাওয়া গিয়েছিল, সেটাই বা কম কী! অনেকের তো লাশই পাওয়া যায় না। কারও–বা ধড় মেলে তো মুণ্ডু খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন ঘটেছিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সিনিয়র প্যারামেডিক মো. নিজামুদ্দিনের ভাগ্যে। আমরা জানি, দেশ জানে ১৯৭৬ সালের ১৮ নভেম্বর নিজামকে গলা কেটে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাঁর মাথাবিহীন দেহ গণস্বাস্থ্যের কর্মীরা একটি পরিত্যক্ত পুকুরে খুঁজে পেয়েছিলেন। তাঁর মাথা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা এবং সাশ্রয়ী মূল্যের ওষুধ দেওয়ার এই সংগ্রামে নিজাম ছিলেন প্রথম শহীদ।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মীরা ১৯৭৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিবছর নিজামুদ্দিনের স্মরণে তাঁর হত্যার বিচারের দাবিতে পদযাত্রা করেন। কর্মীরা কেন্দ্র থেকে হেঁটে যান শিমুলিয়ার সেই উপকেন্দ্রে, যেখানে তাঁকে হত্যা করে দেহ থেকে মুণ্ডুটা আলাদা করে ফেলা হয়েছিল। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র শুরু থেকেই সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা এবং মানুষের নাগালের মধ্যে সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এই কাজের অংশ হিসেবে প্রত্যন্ত গ্রামে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য উপকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়।

এমনই এক উপকেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন নিজামুদ্দিন। মানুষের দোরগোড়ায় সস্তায় বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা–সুবিধা নিয়ে যাওয়ার এই পদক্ষেপ অনেকের পছন্দ হয়নি। সনাতন ব্যয়বহুল এবং শোষণমূলক চিকিৎসার সুবিধাভোগীরা অঙ্কুরেই এসব পদক্ষেপ ধ্বংসের পথে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নিজাম হত্যা ছিল সেসব ষড়যন্ত্রের একটি অংশ।

Also Read: পৌনে ২০০ বছরেও শেষ হলো না সাঁওতালদের হুল!

অন্যায্য ব্যবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টায় গণস্বাস্থ্যের নানা পদক্ষেপের অগ্রবর্তী কর্মীদের অনেককেই নির্যাতন, মারধর এবং নিজামের মতো হত্যার শিকার হতে হয়েছে। সাইকেলে চড়ে গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত মিনু বেগমকে ইট মেরে ট্রাকচাপা দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল সাভারের রাস্তায়। বিচার হয়নি।

জয়কুড়ের কানু, শিমুলিয়ার নিজাম, সাভারের মিনুসহ সারা দেশে গণসংগঠন ও উন্নয়ন প্রচেষ্টার কর্মীদের খুনের বিচার না হওয়ায় কায়েমি স্বার্থের রক্ষকেরা এমনকি স্রেফ ছিনতাইকারী দুর্বৃত্তদের ধারণা হয়েছে, এঁদের খুন করলে কিছু হয় না। এঁদের মামলা নিয়ে কোর্ট–কাছারি করার দম নেই কারও।

সাত বছর আগে ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর নিজেদের জমি রক্ষা করতে গিয়ে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে খুন হন তিন সাঁওতাল; শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি আর রমেশ টুডু। প্রতিবছর মিথ্যা তির–ধনুক নিয়ে বিচার চেয়ে মিছিল করেন সাঁওতাল নারীরা। ঢাকা থেকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার আদায়ে দাবিতে সোচ্চার বুদ্ধিজীবীরা বাণী পাঠান, সৈয়দপুর হয়ে দু-একজন হাজির হন, গাঁদা ফুলের মালা পরে বক্তৃতা করেন। কিন্তু মামলার চাকা ঘুরে না।

উন্নয়নকর্মী রাধা রানী হালদার ২০০৯ সালে খুন হন শরীয়তপুরের তুলসার ইউনিয়নের বাইশরশি গ্রাম থেকে ফেরার পথে। ১৫ বছর আগের সেই ঘটনা এখন আর কারও মনেও পড়ে না। সন্তানসম্ভবা নিহত রাধা রানী হালদারের নামে এখন আর কেউ মিছিল করে না। আসামি কালাম, মতালেব, নুর হোসেন, শওকত হোসেনরা ঘুরে বেড়ায়, সমঝোতার বাণী শোনায়।

দু–একটা খুনের কিনারা হয় বৈকি

এ বছরের ৮ মে উন্নয়নকর্মী মো. বেলাল হোসাইনের হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতএকই সঙ্গে ঘটনার আলামত নষ্ট করার দায়ে আসামিকে আরও সাত বছর কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছেন বিচারক। পাঁচ বছর আগে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন।

নিখোঁজের দুই দিন পর ২০১৮ সালের ১৪ মে সকাল নয়টার সময় খিলগাঁওয়ে বালু নদে এক যুবকের লাশ ভেসে ওঠে। পরে উন্নয়ন সংস্থা আশার কর্মকর্তারা সেটি বেলালের লাশ বলে শনাক্ত করেন। তাঁর গলায় প্লাস্টিক মোড়ানো এবং পেটের নাড়িভুঁড়ি কেটে বের করে দেওয়া হয়েছিল। লাশ যেন ভেসে না ওঠে, সে জন্য পেটের ভেতর পাথর ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল। সহকর্মীদের চেষ্টায় ঘটনার প্রকৃত আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

খুনখারাবি চলছেই

গত ৫ মার্চ বেসরকারি সংস্থা ‘পদক্ষেপ’–এর কর্মী চম্পা চাকমাকে (২৮) ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। অফিস থেকে ফেরার পথে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ধামাইরহাট এলাকায় তিনি খুন হন।

গত ১৫ জুন খুন হয়েছেন ব্র্যাকের কর্মী রেজাউল করিম (৫০) সাভারের রাজফুলবাড়িয়া এলাকায়।

বাংলাদেশের সংবিধান বলছে, প্রত্যেক নাগরিক আইনের আশ্রয় নেওয়ার অবারিত সুযোগ পাবে। উন্নয়নকর্মীদের হত্যার ঘটনায় ভুক্তভোগীর পরিবার বিচার পেয়েছে, এমন নজির খুব কম। বিচার চাইতে গেলেও নানা রকমের বাধা আসে। তবে কি আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকব?

  • গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

  • nayeem5508@gmail.com