Thank you for trying Sticky AMP!!

৭ জনের মৃত্যু: বিস্ফোরণ মেয়াদোত্তীর্ণ জীবাণুনাশক থেকে

তুরাগে বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন রিকশা গ্যারেজ ও ভাঙারি দোকানের মালিক গাজী মাজহারুল ইসলাম। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীকে হারিয়ে দুর্দশায় পড়েছেন স্ত্রী–সন্তানেরা। স্বামীর এভাবে মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মাজহারুলের স্ত্রী রোকসানা আক্তার

রাজধানীর তুরাগে ভাঙারির দোকানে বিস্ফোরণ ঘটেছে কনটেইনারে রাখা মেয়াদোত্তীর্ণ জীবাণুনাশক (হ্যান্ডস্যানিটাইজার) থেকে। প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে এ তথ্য জানিয়ে পুলিশ বলছে, ‘ড. রাজেশ জার্ম কিল স্প্রে ফোম’ জীবাণুনাশক ভারত থেকে আমদানি করে লাফজ ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের গুদাম থেকেই কনটেইনারগুলো ভাঙারির দোকানে এসেছে।

গত শনিবার দুপুরের ওই বিস্ফোরণে ভাঙারি দোকানের মালিক গাজী মাজহারুল ইসলামসহ আটজন দগ্ধ হন। তাঁদের মধ্যে সাতজনই মারা গেছেন। একজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছেন। এ ঘটনায় বুধবার পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।

গত মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা যায়, মাজহারুল ইসলাম প্রায় ৩০ বছর ধরে তুরাগের রাজাবাড়ি এলাকায় রিকশার গ্যারেজ চালান। বাড়তি আয়ের আশায় গ্যারেজের পাশেই একটি ভাঙারির দোকান দেন তিনি। ওই দোকান থেকেই বিস্ফোরণ ঘটে।

Also Read: বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির টাকা দিয়েই সারতে হলো বাবার দাফন

পুলিশের একটি সূত্রের ভাষ্য, ঘটনার সময় কয়েকজন মেয়াদোত্তীর্ণ ‘ড. রাজেশ জার্ম কিল স্প্রে ফোম’–এর কনটেইনার থেকে ফোম বের করে সেগুলো খালি করছিলেন। এতে করে ভাঙারির দোকানটি একটি গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়। সেখানে কোনোভাবে ‘স্পার্ক’ হলে বিস্ফোরণ ঘটে।

পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, এসব মেয়াদোত্তীর্ণ স্যানিটাইজার ভাঙারির দোকানে কারা নিয়ে এসেছে, তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।


লাফজ যেসব পণ্য আবাসিক এলাকায় রাখছে, এগুলো রাখার কোনো সুযোগ আছে কি না, জানতে চাইলে ডিসি মোর্শেদ আলম বলেন, এ ধরনের দাহ্য পদার্থ যেকোনো জায়গায় রাখা যায় না। এর একটি প্রক্রিয়া আছে। এ ধরনের কিছু গুদামের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিস্ফোরণের পর ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট আগুন নেভায়। সেখানে কোনো দাহ্য পদার্থ ছিল কি না, এ বিষয়ে তারা কোনো অনুসন্ধান করেনি। উত্তরা ফায়ার স্টেশনের ব্যবস্থাপক সৈয়দ মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস কোনো তদন্ত করছে না। বিষয়টি সদর দপ্তরকে জানানো হয়েছে। সদর দপ্তর মনে করলে তদন্ত করা হবে।

বিস্ফোরণের সময় পাশের একটি চায়ের দোকানে বসে ছিলেন জসীম উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি। তিনি দাবি করেন, ঘটনাস্থল থেকে ড. রাজেশ জার্ম কিল স্প্রে ফোমের একটি কনটেইনার সংগ্রহ করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। সেটি স্প্রে করে এই প্রতিবেদককে দেখিয়েছেন। সেই কনটেইনার থেকে হালকা ফোমের মতো তরল বের হয়ে আসে।

কয়েক শ গজ দূরেই আবাসিক ভবনে লাফজের গুদাম

ঘটনাস্থল থেকে কয়েক শ গজ দূরেই একটি ছয়তলা ভবনের তিনটি তলা ভাড়া নিয়ে গুদাম বানিয়েছে লাফজ। সেখানেই মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য মজুত করে তারা। ওই ভবনে গিয়ে দেখা গেছে, একটি গাড়ির বড় কনটেইনারে গুদাম থেকে মালামাল নামানো হচ্ছে। ভবনের চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ধরনের পণ্য কার্টনে মজুত করা।

দুটি তলার বাইরের দেয়ালে সাঁটানো কাগজে লেখা রয়েছে, যেকোনো মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বাধ্যতামূলকভাবে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানকে যথাসময়ে অবহিত করে এবং সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করে ডিসপোজাল (ধ্বংস) করতে হবে। এ কাজে যথাযথ নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা পদ্ধতি অবশ্যই মেনে চলতে হবে। ওই কাজে যদি কোনো অনিয়ম পাওয়া যায়, তবে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এমন নির্দেশনার পরও মেয়াদোত্তীর্ণ দাহ্য কীভাবে পাশের গ্যারেজে গেল, এ বিষয়ে খোঁজ নিতে ভবনের ভেতরে গিয়ে দায়িত্বশীল কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে ভবন থেকে বাইরে আসার পর মো. তৌফিক নামের এক ব্যক্তি নিজেকে এই গুদামের ব্যবস্থাপক ও লাফজের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দেন। তবে তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য দায়িত্বশীল ব্যক্তি কে জানতে চাইলে তৌফিক এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।

অনিশ্চয়তায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবার

বিস্ফোরণে ভাঙারির দোকানের মালিক গাজী মাজহারুল ও তাঁর পালিত পুত্র আলমগীর হোসেনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার রাজাবাড়ি এলাকায় গিয়ে কথা হয় মাজহারুলের স্ত্রী রোকসানা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, বিস্ফোরণে গ্যারেজের অন্তত ২০টি রিকশা পুড়ে গেছে। অবশিষ্ট কিছু নেই। তাঁর তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে এবার এইচএসসি পাস করেছেন। মাজহারুল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। পরিবারটি এখন দিশাহারা।

বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া একজন লালমনিরহাটের মিজানুর রহমান। ৩৫ বছর বয়সী এই যুবক তুরাগের রাজাবাড়ি এলাকাতে স্ত্রী ও ছয় বছর বয়সী এক সন্তানকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন। তাঁর স্ত্রী জহিরুন আক্তার সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বাসায় গিয়ে দেখা যায়, অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছেন জহিরুন। প্রতিবেশীরা তাঁকে ধরে বারান্দায় নিয়ে আসেন। স্বামীর কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর এখন ঘরভাড়া দেবেন কীভাবে জানেন না। এখন কোনো কাজ করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে সামনে তিনি শুধুই অন্ধকার দেখছেন।

রাজাবাড়ি এলাকায় গিয়ে মিজানের পরিবারের খোঁজ করার সময় স্থানীয় যুবক মো. মানিকের সঙ্গে কথা হয়। তিনিই এই প্রতিবেদককে মিজানের বাসায় নিয়ে যান। তিনি বলেন, মারা যাওয়া সাতজনের মধ্যে পাঁচজনই রিকশাচালক। গত সোমবার রাতে মারা যাওয়া মাসুম আলী ও আল আমিনের লাশ গ্রামে পাঠানোর জন্য স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে চাঁদা নিতে হয়েছে। এমন পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু পরিবারগুলোকে একবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে।