Thank you for trying Sticky AMP!!

লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনে সাফারি পার্ক নির্মাণ বাতিল চেয়ে বিশিষ্টজনদের চিঠি

লাঠিটিলা সংর‌ক্ষিত বনভূমিতে সাফারি পার্ক নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে গত ১১ অক্টোবর প্রথম আলোয় খবর প্রকাশ হয়

লাঠিটিলা সংর‌ক্ষিত বনভূমিতে সাফারি পার্ক নির্মাণ প্রকল্প বাতিল চেয়েছেন দেশের সাতজন বিশিষ্ট নাগরিক। যাঁদের মধ্যে অধিকারকর্মী ও পরিবেশবাদী সংগঠকেরা রয়েছেন। তাঁরা মৌলভীবাজারের জুড়ি উপজেলায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ ওই বনে সাফারি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনাকে সংরক্ষিত বনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, অসংবেদনশীল ও অবিবেচনাপ্রসূত বলে মন্তব্য করেছেন।

বিশিষ্টজনেরা সরকারের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন মন্ত্রী ও সচিবের উদ্দেশে দেওয়া এক চিঠিতে এ দাবি করেন। চিঠিতে তাঁরা বলেন, দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সংর‌ক্ষিত বনে গাছ কাটা ও অনুমতি ছাড়া প্রবেশ যেখানে আইনিভাবে নিষিদ্ধ, সেখানে সংর‌ক্ষিত বনকে ‘সাফারি পার্ক’–এ রূপান্তর করা ওই বনকে ধ্বংস করার সুযোগ তৈরি করবে।

বিশিষ্টজনেরা বলেন, জনস্বার্থকে উপেক্ষা করে এবং আইনি বিধিনিষেধের ব্যত্যয় ঘটিয়ে শুধু প্রকল্পের স্বার্থে বন বিভাগ তাদের এই সাফারি পার্ক প্রকল্পে বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করেছে, যা অত্যন্ত আপত্তিকর। তাঁরা বলেছেন, যে বন বিভাগ সংর‌ক্ষিত বন থাকা অবস্থায় অবৈধ দখলদার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, সে বন বিভাগ সাফারি পার্ক পরিচালনার মাধ্যমে টিকিট বিক্রি করে আর বনে বিনোদনের মাধ্যম তৈরি করে কীভাবে এই প্রকল্পের মাধ্যমে বন আর বন্য প্রাণী রক্ষা করবে, তা বোধগম্য নয়।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী ছাড়াও অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) এবং প্রধান বন সংরক্ষক বরাবর চিঠিটি দেওয়া হয়েছে।

চিঠিদাতারা হলেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের সভাপতি সুলতানা কামাল, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং উদ্ভিদবিষয়ক লেখক ও গবেষক এবং প্রকৃতিবিষয়ক সংগঠন তরুপল্লবের সাধারণ সম্পাদক মোকারম হোসেন।

সংরক্ষিত বনে সাফারি পার্ক করা কেন সাংঘর্ষিক তার ব্যাখ্যা তুলে ধরে চিঠিতে বলা হয়, দেশের প্রচলিত আইনে কোনো বনভূমিকে ‘সংর‌ক্ষিত বন’ ঘোষণার উদ্দেশ্য হলো, বনকে অনুপ্রবেশ আর সাধারণের যাতায়াত থেকে রক্ষা করা। সেখানে ‘সাফারি পার্ক’–এর উদ্দেশ্য হলো, ‘দেশি-বিদেশি বন্য প্রাণীকে প্রাকৃতিক পরিবেশে রেখে বংশবৃদ্ধির সুযোগ দেওয়া। তাদের উন্মুক্ত অবস্থায় বিচরণ করতে দেওয়া।’ অর্থাৎ সংর‌ক্ষিত বন আর সাফারি পার্কের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।

চিঠিতে লাঠিটিলা বনের গুরুত্ব তুলে ধরে বলা হয়েছে, মৌলভীবাজার শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে জুড়ি উপজেলার জুড়ি রেঞ্জের অন্তর্গত ‘লাঠিটিলা’ প্রাকৃতিকভাবে ক্রা‌ন্তীয় মিশ্র চিরসবুজ একটি বন। ১৯২০ সালে সরকার এ বনের ৫ হাজার ৬৩১ একর এলাকাকে সংর‌ক্ষিত বনভূমি ঘোষণা করে। লাঠিটিলা বনটি পাথারিয়া হিলি রিজার্ভ ফরেস্টের অংশ। এ বনে ২০৯ প্রজাতির বন্য প্রাণী এবং ৬০৩ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। বিরল ও বিপন্নপ্রায় মায়া হরিণ, বুনো শূকর, উল্লুক, উল্টো লেজি বানর, ক্ষুদ্র নখযুক্ত উদ্‌বিড়াল এখনো এ বনে দেখা যায়। এটি দেশের ছয়টি আন্তসীমান্ত সংরক্ষিত বনের একটি।

চিঠিতে বলা হয়, বন বিভাগ অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের নামে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ সংর‌ক্ষিত এ বনভূমিতে সাফারি পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। সাফারি পার্ক–সংক্রান্ত বন বিভাগের প্রস্তাবিত প্রকল্পে সংর‌ক্ষিত এই বনভূমিতে গাছ ও পাহাড় কেটে বিভিন্ন শ্রেণির সড়ক, ওয়াকওয়ে, আরসিসি বাঁধ, প্রাণী হাসপাতাল, গুদাম, গাড়ি ও বাস রাখার স্থান, বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য জেনারেটরসহ সাবস্টেশন নির্মাণ, সাইনেজ ও সাউন্ড সিস্টেম স্থাপনসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণের প্রস্তাবনা রয়েছে। যা পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্পের মূল্যায়ন কমিটি গত ৩ সেপ্টেম্বর সভার কার্যবিবরণীতে স্পষ্ট।

চিঠিতে আরও বলা হয়, মৌলভীবাজারে বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক, মাধবকু্ল ইকোপার্কসহ কিছু পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় এটি প্রমাণিত যে পর্যটকদের চাপে ও বন বিভাগের নানা বিতর্কিত প্রকল্প ও কর্মকাণ্ডের কারণে মৌলভীবাজারের প্রাকৃতিক বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকিতে রয়েছে। বনগুলো বৃক্ষশূন্য হচ্ছে। ফলে সেখানকার বন্য প্রাণী আবাস হারাচ্ছে। লাঠিটিলার সংর‌ক্ষিত বনকে সাফারি পার্কে পরিণত করলে তা যে এই বন ও এর সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংস করবে, তা দেশের প্রথিতযশা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের যৌথ গবেষণায় সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত।

Also Read: বনমন্ত্রীর এলাকায় সংরক্ষিত বন কেটে হবে সাফারি পার্ক, ‘আত্মঘাতী’ প্রকল্প বলছেন পরিবেশবিদেরা

বিশিষ্টজনেরা বলেন, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দেশের বনভূমিÿরক্ষায় সরকারের সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তা সত্ত্বেও বন সংরক্ষণে আইনিভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং এর অধীন বন বিভাগের আওতায় থাকা সংর‌ক্ষিত বনকে সাফারি পার্কে পরিণত করার এমন বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বাস্তবায়িত হলে তাÿক্ষমতার অপব্যবহারের একটি নজির সৃষ্টি করবে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং বন বিভাগের এমন অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত বাতিল না হলে প্রশাসনের সঙ্গে পরিবেশবাদী ও সাধারণ জনগণের দূরত্ব বেড়ে যাবে। পরিবেশ প্রশাসনে অনাস্থা সৃষ্টি হবে।

সাফারি পার্ক নির্মাণ প্রকল্প বাতিলসহ এ বনে বনবিরুদ্ধ সব কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধের অনুরোধ এবং নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে লাঠিটিলা সংর‌ক্ষিত বনের যথাযথ সংরক্ষণের জোরালো দাবি জানিয়েছেন চিঠিদাতারা।