Thank you for trying Sticky AMP!!

রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টি পদ্ধতিতে দেশে প্রথমবারের মতো হৃদ্‌যন্ত্রের রক্তনালিতে স্টেন্ট পরানো কুষ্টিয়ার আজম আলীর পাশে চিকিৎসক দল

রোবট দিয়ে হার্টে রিং পরানোর পর আজম ও মোর্শেদের মুখে হাসি ফুটেছে

হৃদ্‌রোগের চিকিৎসায় ‘রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টি’ যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো দেশে দুজন রোগীর হৃদ্‌যন্ত্রের রক্তনালিতে রোবটের মাধ্যমে স্টেন্ট (রিং নামে বেশি পরিচিত) পরানো হয়েছে। গত রোববার রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে তাঁদের হৃদ্‌যন্ত্রে রিং পরানো হয়।

দুই ব্যক্তির একজন কুষ্টিয়ার আজম আলী। একগাল হেসে ষাটোর্ধ্ব এই ব্যক্তি বললেন, ‘বিশ-বাইশ বছর ধরে আমার হার্টের সমস্যা (হৃদ্‌রোগ) ছিল। ডাক্তাররা রোবট না কী দিয়া জানি আমার অপারেশন করল। তবে আমি কিছুই টের পাইনি। অপারেশন হওয়ার পর থেকেই নিজেকে কেমন শান্ত লাগছে। সুস্থ আছি।’

আজ মঙ্গলবার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কথা হয় আজম আলীর সঙ্গে। তিন দিনের মাথায় স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে হাসপাতাল ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। চিকিৎসকেরাও তাঁকে ছুটি দিতে চাচ্ছেন।

মোর্শেদ আলমের সঙ্গে চিকিৎসকদলের প্রধান প্রদীপ কুমার কর্মকার

বয়স হওয়ায় কৃষক আজম আলীকে (৬৫) কাজ করতে দেন না ছেলেরা। ছেলেদের একজন সিঙ্গাপুরে থাকেন। আজম আলীর স্ত্রী ইজারুন নেসা ও আরেক ছেলে মনিরুল ইসলাম হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে আছেন।

মনিরুল ইসলাম জানান, এর আগে নানা জায়গায় বাবার চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু টাকা খরচ হলেও তেমন লাভ হয়নি। লোকজনের কাছে শোনার পর তাঁর বাবাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসেন।

অস্ত্রোপচারকক্ষে রোবট দিয়ে হৃদ্‌যন্ত্রে স্টেন্ট স্থাপন করছেন চিকিৎসকেরা

গত রোববার পরীক্ষামূলকভাবে রোবটের মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো দুই হৃদ্‌রোগীর হৃদ্‌যন্ত্রে স্টেন্ট পরানো হয়। আজম আলীর সঙ্গে অন্যজন ছিলেন মোর্শেদ আলম (৫০)। তিনিও এখন সুস্থ আছেন। আজ দেখা গেল, হাসপাতালের শয্যায় বসে মোর্শেদ আলম হাসিমুখে চিকিৎসক ও অন্যদের সঙ্গে কথা বলছেন।  

চাঁদপুরের মোর্শেদ আলম গত সাত বছর ধরে সৌদি আরবের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। সৌদি আরবে হৃদ্‌রোগ ধরা পড়লেও পরবর্তী চিকিৎসা করাতে ভরসা পাননি। তিনি জানান, লোকমুখে দেশের এই হাসপাতালের কথা শুনে চিকিৎসা করাতে এসেছেন। আড়াই মাস পরে আবার সৌদি আরবে ফিরে যাবেন।

চর্বি জমে বা অন্য কোনো কারণে হৃদ্‌যন্ত্রের রক্তনালি সংকুচিত হয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ বা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এটাকে বলা হয় হার্টের ব্লক। মোর্শেদ আলম ও আজম আলীর তিনটি করে ব্লক ছিল। দুজনই হাসপাতাল থেকে একটি করে স্টেন্ট বিনা মূল্যে পেয়েছেন। এ ছাড়া রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টির জন্য বাড়তি খরচ দিতে হয়নি তাঁদের।

রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টির উদ্বোধন করেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক মো. কামরুল হাসান (মিলন) এবং কার্ডিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মো. সালাউদ্দিন উল্লুবি।

স্ত্রী ও ছেলের সাথে ষাটোর্ধ্ব কুষ্টিয়ার আজম আলী

রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো দুই রোগীর হৃদ্‌যন্ত্রে স্টেন্ট পরান জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক প্রদীপ কুমার কর্মকারের নেতৃত্বাধীন একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল। চিকিৎসক দলে ছিলেন পিনাকী রঞ্জন দাস, আরিফুর রহমান, সাইদুর রহমান, ফারহানা আহমেদ, মো. হোসনি আমীন, বাদল চন্দ্র বর্মন, নাজমুল হক ভূঁইয়া, আবু সালেহ ও নুসরাত রহমান।

কথা হলো চিকিৎসক প্রদীপ কুমার কর্মকারের সঙ্গে। তিনি জানান, রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টি বর্তমানে হার্টের রিং পরানোর সর্বাধুনিক ও সর্বশেষ প্রযুক্তি। যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিশ্বের ১৬০টি দেশে রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টি সেন্টার আছে।

প্রদীপ কুমার কর্মকার বলেন, রোবোক্যাথ আর ওয়ান সিস্টেমে ক্যাথল্যাবে একটি রোবোটিক হাত থাকে। আর দূর থেকে একটি মেশিনে তা নিয়ন্ত্রণ করেন চিকিৎসকেরা। আগে চিকিৎসকেরা সরাসরি নিজের চোখে দেখে নিজের হাতে যে কাজটি করতেন, তা–ই এখন করা হচ্ছে রোবটের মাধ্যমে। এতে কাজটি অনেক নিখুঁত হচ্ছে। অস্ত্রোপচারে সময় কম লাগছে। এই দুই রোগীর অস্ত্রোপচারে সময় লেগেছে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট যা সরাসরি করলে লাগত এক ঘণ্টার বেশি।

মোর্শেদ আলমের সঙ্গে চিকিৎসক দল

নতুন পদ্ধতির সুবিধা
প্রদীপ কুমার কর্মকার বলেন, অনেক সময় হার্টের রিং নিখুঁত পজিশনের (সঠিক জায়গায় স্থাপন) জন্য এক মিলিমিটার সামনে অথবা এক মিলিমিটার পেছনে নিতে হয়। হাত দিয়ে করলে এ কাজটি করা কঠিন; কিন্তু রোবটের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে করা যায়।

সরাসরি এ সেবা দেওয়ার সময় রেডিয়েশনের কারণে অনেক চিকিৎসক ব্রেন ক্যানসার, চোখে ছানিপড়াসহ বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিতে থাকেন বলে জানান চিকিৎসক প্রদীপ কুমার কর্মকার। তিনি বলেন, হৃদ্‌রোগ চিকিৎসকেরা যখন অস্ত্রোপচারকক্ষে কাজ করেন, তখন রেডিয়েশন থেকে সুরক্ষার জন্য ১২ থেকে ১৫ পাউন্ড ওজনের একটি বিশেষ পোশাক দীর্ঘক্ষণ পরে থাকতে হয়। এতে ঘাড়ের নার্ভে চাপ পড়ে। পরবর্তী সময়ে ঘাড় ও হাতে ব্যথার কারণে এনজিওপ্লাস্টি করতে পারেন না। কিন্ত রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে রেডিয়েশন ও বিশেষ জামা পরা ছাড়াই ক্যাথল্যাবের কন্ট্রোল রুমে, তাঁর অফিসে বসে এবং সুযোগ-সুবিধা থাকলে বাসায় বসে রোগীর হার্টে রিং পরাতে পারবেন।

রোগীদের জন্য সুবিধা হলো, এ পদ্ধতিতে সময় লাগে কম। হার্টের ভেতরে ক্যাথেটার, ওয়্যার (তার), বেলুন, রিং যত কম সময় রাখা যায় রোগীর জন্য তত নিরাপদ। তাই এ পদ্ধতিতে জটিলতা কম। দেশে স্থায়ীভাবে এ চিকিৎসাপদ্ধতি চালু হলে রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে না। খরচের বোঝা কমবে। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। দেশের টাকা দেশেই থাকবে।

চিকিৎসক দলে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক প্রদীপ কুমার কর্মকার

স্থায়ীভাবে চালুর আহ্বান
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানাল, পরীক্ষামূলকভাবে রোবোটিক এনজিওপ্লাস্টি শুরু করেছে তারা। এ কাজে যে যন্ত্রটি ব্যবহার করেছে, সেটি পরীক্ষামূলকভাবে এক মাস ব্যবহারের জন্য ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে আনা হয়েছে। বাংলাদেশে অবকাঠামোর সঙ্গে এই যন্ত্র সহায়ক কি না, তা যাছাই–বাছাইয়ের জন্য বিনা মূল্যে এটি আনা হয়েছে। এর মাধ্যমে এক মাসে ১০ জন রোগীকে এ সেবা দেওয়া হবে। তারপর যন্ত্রটি আবার ফ্রান্সে পাঠানো হবে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানাল, যদি রোবোটিক পদ্ধতিটি বাংলাদেশের অবকাঠামোর সঙ্গে সহায়ক হয় তাহলে তারা মেশিনটি কিনতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানাবে। এতে দেশে স্থায়ীভাবে রোবোটিক পদ্ধতিতে হার্টের রিং পরানো সম্ভব হবে। তখন চিকিৎসার মোট খরচের সঙ্গে রোগীকে বাড়তি মাত্র ২০ হাজার টাকা যোগ করতে হবে।

প্রদীপ কুমার কর্মকার জানান, হাসপাতালের অবকাঠানো ও দক্ষ চিকিৎসক সবই আছে। এই যন্ত্র ব্যবহার করতে হাসপাতালের কোনো অবকাঠামো পরিবর্তন করতে হয়নি।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক মো. কামরুল হাসান মিলন প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের একটি আধুনিক পদ্ধতি চালুর বিষয়টি অবশ্যই গর্বের। সরকার যন্ত্রটি কিনলে আরও সহজে হৃদ্‌রোগের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে।