Thank you for trying Sticky AMP!!

চিঠির বাক্সে লেখা ছিল নাম 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু-ফারসি বিভাগের প্রয়াত চেয়ারম্যান কানিজ লিখেছিলেন, চল্লিশের দশক থেকে ষাটের দশকের মধ্যে অনেক বিত্তবান পরিবারের ছিল নিজস্ব রানার। যাঁরা ঘণ্টা বাজিয়ে বাজিয়ে চিঠি বিলি করতেন। 

এখন আর চিঠির বাক্সে চিঠি থাকে না। ২০১৭ সালে কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর বাড়ির চিঠির বাক্স। ছবি: সংগৃহীত

চিঠির বাক্সে নিজের সঙ্গে স্ত্রীর নামটি লিখিয়েছিলেন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক শওকত আলী। স্ত্রী মারা যাওয়ার পরও স্মৃতি হিসেবে নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে রেখেছিলেন তাঁকে। সে ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল একটা লাল বাক্স। রাজধানীর টিকাটুলীর ধূপখোলা সড়কের বাড়িতে প্রবেশের মুখে ডান দিকের দেয়ালে রাখা আছে সেটি। শার্টের বুক পকেটে কলম গুঁজে রাখার মতো ওপর দিক থেকে চিঠি ফেলার ব্যবস্থা।

প্রাপক আর বাহকের সময় না মিললেও যাতে মূল্যবান চিঠিটির অযত্ন না হয়, তাই বানানো হতো এই ‘লেটার বক্স’ বা চিঠির বাক্স। কাঠের নকশার চারকোনা বাক্স থাকত কোনো ছাউনি দিয়ে। আর রোদ-বৃষ্টি সহনশীল চাইলে বানানো হতো স্টিল বা টিন দিয়ে। আভিজাত্যের মাপে কাঠের বাক্সের কদর ছিল বেশি। কাঠের এমন বাক্স ছিল রাজধানীর পুরান ঢাকার অনেক বাড়িতে। ছিল মফস্‌সলের শহরতলির কিছু বাড়ির প্রবেশমুখে। রাজধানীর পুরান ঢাকার সাতরওজার কাছে নবাব ছোট্টান হাউস, হাটুরিয়া হাউস, শারাফ হাউস, সোবহান মঞ্জিল, মির্জা বাড়ির সদর দরজায় ছিল এককালে কাঠের চিঠির বাক্স। ডাক বিভাগের দায়িত্বরত ব্যক্তিরাই নিয়ে আসতেন চিঠি। তবে তারও আগের ইতিহাসটা সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা সেই ‘রানার ছুটেছে রানার, ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে’র। তাঁরা কাঁধে কাপড়ের বা চটের বস্তার ঠুলিতে ভরে হাতে লাঠি আর হারিকেন নিয়ে ছুটে চলতেন মানুষের খবর পৌঁছে দিতে। 

বংশালের আবুল হাসনাত রোডে ঢাকার সম্ভ্রান্ত অনেক পরিবারের সদস্যদের বসবাস আছে এখনো। তাঁদের বাড়িগুলো আগের আমলের ধাঁচেই রেখে দেওয়া হয়েছে। তবে চিঠির বাক্সগুলো আর নেই। এই পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের একজন সৈয়দ আহমাদ আলী। প্রথম আলোকে তিনি জানান, তাঁর বড় ফুফু ডক্টর কানিজ-ই-বাতুল নিজের দিনলিপিতে লিখে গেছেন সেই রানারদের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু-ফারসি বিভাগের প্রয়াত চেয়ারম্যান কানিজ লিখেছিলেন, চল্লিশের দশক থেকে ষাটের দশকের মধ্যে অনেক বিত্তবান পরিবারের ছিল নিজস্ব রানার। যাঁরা ঘণ্টা বাজিয়ে বাজিয়ে চিঠি বিলি করতেন। হাতে থাকত বল্লমের মতো একটা লাঠি। তখন ওই এলাকার অনেক বাড়ির সদর দরজায় লাগানো ছিল কাঠের চিঠির বাক্স। রানার এবং বাক্স দুটোই গত হয়েছে অনেক দিন আগে।

ঔপন্যাসিক শওকত আলীর বিরতি ভিলার প্রবেশমুখে এখনো আছে সেই বাক্সটা। তাঁর পরিবারের সদস্য ফারজানা আফরোজ জানালেন, এখনো দু-একটা চিঠি আসে, তবে সেসব কোনো সংস্থা বা ব্যাংকের কাগজপত্র। এটি ব্যক্তির ঠিকানায় বলে তা-ও হয়তো দু-একটা চিঠি আসে। কিন্তু যেসব বাক্সের মালিক বদলায়, সেই বাক্সগুলো এখন থাকে অন্ধকারের ভেতর মাকড়সার জালে আটকানো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক ভবনগুলোর অধিকাংশে ছিল এই চিঠির বাক্স। পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা গেল, দক্ষিণ ফুলার রোডের ৫৮ নম্বর ভবনের নিচতলা আর শহীদ মিনার কোয়ার্টারের অপরাজিতা, চন্দ্রমল্লিকা নামের দুই কোয়ার্টারের নিচতলায় আছে কয়েকটি কাঠের তৈরি পুরোনো চিঠির বাক্স। সেখানে শিশুদের সাইকেল, পুরোনো বইপত্রের ডাইয়ের ভেতর আটকে পড়েছে বাক্সগুলো। শহীদ মিনার কোয়ার্টার চত্বরের ভেতর প্রায় ৩০ বছর ধরে পাহারা দিচ্ছেন মো. আবদুল হাই। বললেন, একসময় রোজ এগুলো খুলে চিঠি সংগ্রহ করতে হতো। এখন কালেভদ্রে কেউ দু-একটা বিলের কাগজ রেখে যায়। ব্যবহার হয় না বলে আর দেখভালের ব্যাপার নেই। এসব বাক্সের প্রতিটির মুখে দেওয়া থাকত ছোট্ট একটা তালা। নিঃসন্দেহে সে তালার চাবিটি থাকত বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির দখলে। 

২০১৮ সালে মৃত্যুর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই স্মৃতি এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল শওকত আলীর। চাবির কথা জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, ‘হারিয়ে ফেলেছি। রয়ে যাওয়া বাক্সটিও এখন চেনা কঠিন। সম্প্রতি রংমিস্ত্রিরা ভুলে সাদা রং করে মুছে দিয়েছেন লিখে রাখা নামা দুটো। যেমন মুছে গেছে রানার এবং কাঠের তৈরি চিঠির বাক্সের গল্পের স্মৃতি।