Thank you for trying Sticky AMP!!

কেন এমন করলে আমাদের সঙ্গে

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com

মার্চের প্রথম সপ্তাহ, আর দশটা সাধারণ দিনের মতোই সেদিনও অফিসে কর্মব্যস্ত, ম্যাড়মেড়ে একটা সময় কাটছিল। ঢাকার বাইরে শেষবার পা দিয়েছি মাস দুয়েক আগে। রাজধানীর কঠিন যান্ত্রিকতায় নিজেকে প্রতিদিন নতুন করে অভ্যস্ত করে নেওয়ার চেষ্টায় সময় সময় দম আটকে আসতে চায়। আমি সবুজের শহরে বেড়ে ওঠা মানুষ। ‘ঢাকাইয়া’ তকমা কারও কারও কাছে সিল্কের টাই, আমার কাছে চিরদিনই ফাঁসের দড়ি। এসবের মধ্যেই প্রতিদিনের খবরের পাতায় নতুন করে যোগ হলো কি নাকি এক ‘নোবেল’ (এক বন্ধুর উচ্চারণে) ভাইরাস! সেই কোন সুদূরের চীন দেশ, জ্ঞান অর্জনের প্রতি নেহাত অনীহা থাকায় সেখানে কোনো দিন যাওয়া হয়নি; আর সেই কোন প্রান্তের ভেনিস, বুড়িগঙ্গার শহরে খেয়ে–পরে বেঁচে থাকা তরুণের চোখে যে শহরকে মনে হয় বুঝিবা সুইমিংপুল দিয়ে ঘেরা—সেই সব অচিন দেশে নাকি হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন শ্বাস নিতে না পেরে মারা যাচ্ছে। কী অদ্ভুত!

দুপুরের খাওয়াটা সেরে রিভলবিং চেয়ারে অযথা দোল খেতে খেতে সেদিন এসব ভাবছিলাম। ‘আরে ব্যাটা, প্রতিদিন দুবেলা রাইদা আর তুরাগের কালো ধোঁয়ায় পেট ভরিয়ে যাচ্ছি, শুকনা কাশিটাও তো হয়নি গত পাঁচ বছরে! ফুটপাতে-ফ্লাইওভারে-ওভারপাসে প্রস্রাবের নোনতা ফ্লেভারকে আমাদের নির্মল, নিঃশঙ্ক সংস্কৃতির অংশ ভেবে আপন করে নিয়েছি সেই কবেই। আর তোরা মুষকো ইউরোপিয়ান, ভালো ভালো খেয়ে মানুষ, এত অল্পে কাবু হয়ে পড়লি?’ সবটাই কেমন গোলমেলে মনে হচ্ছিল সেদিন। হঠাৎ এক সহকর্মী পাশে এসে দাঁড়ানোয় চিন্তায় ছেদ পড়ল। তার প্রস্তাবে সায় দিয়ে দুজনে মিলে অফিসের নিচে নামলাম, চায়ের কাপে ভাতঘুম তাড়ানো আর কিছু উদ্দেশ্যহীন পরচর্চার লোভে।

চা-ওয়ালার ব্যস্ত হাত একবার এই কৌটার এলাচে যায়, আরেকবার ওই বাটির নিরীহ লেবুকুচিকে তুলে এনে কচলে অত্যাচার করে। দেখি আর ভাবি, স্রষ্টাও বুঝি কোনো এক নাটকের মঞ্চে চা-ওয়ালার চরিত্রে অভিনয় করে যাচ্ছেন নিপুণভাবে। আজ এর লটারি লাগিয়ে দিচ্ছেন, কাল ওর সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছেন। এলাচি, তেজপাতা, পুদিনা আর মাল্টা—আমাদের একেকজনের জীবন হয়ে যাচ্ছে একেক স্বাদের চা। সেই চা পছন্দ হোক বা না হোক, দিয়ে যেতে হবে চুমুকের পর চুমুক।

কথায় কথায় সহকর্মীকে সেদিন বলছিলাম, ‘জানো, একসময় খুব ভাবতাম জীবনটা বেশ করে উপভোগ করব। গোটা দশেক কবিতা লিখেছিলাম ভার্সিটির লাল বাসে বসে বসে। দুটো শর্ট ফিল্মের স্ক্রিপ্ট লিখেছিলাম, মনের খাতায় স্টোরিবোর্ড এঁকে লাল–নীল কালি দিয়ে ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল ঠিক করেছিলাম। রাত জেগে জর্জ শ্যলার, জন ক্রকারের বই পড়ে ভোররাতে স্বপ্ন দেখেছিলাম একটা মাউন্টেন লায়নকে পোষ মানিয়ে খেলা করছি। ঠিক করেছিলাম চাকরিবাকরি করে কিছু পয়সা জমলে রাস্তার কুকুর–বিড়ালদের জন্য একটা শেল্টার করব। আজকাল এসবের কিছুই আর মাথায় আসে না।’

একটু সহমর্মিতার সুরে সহকর্মীর জবাব, ‘শুক্র শনিবার তো ছুটিই থাকে। তখন এসব কেন করো না?’

জবাবে ক্লান্তি আর অবসাদের পুরোনো ফিরিস্তি দেওয়াই যেত। আমি শুধু মুখ বাঁকিয়ে বললাম, ‘হুম, সবাই তো এখন সেটাই বলছে।’

‘কোনটা?’, সহকর্মীর চোখেমুখে কৌতূহল, অস্পষ্টতা।

‘এই যে কেন কর না। কেন করোনা। কেন Corona?’

এর কিছুদিন পর থেকেই আমি আর আমার সেই সহকর্মী, আরও অনেকের মতোই, হোম অফিস নামক প্রহসনের শিকার। আমাদের সবার মনে এখনো সেই একই প্রশ্ন।

কেন করোনা? কেন এমন করলে আমাদের সঙ্গে?


*লেখক: চাকরিজীবী, ঢাকা