Thank you for trying Sticky AMP!!

ঢাকার স্বাস্থ্যসচেতন নাগরিকের জিম-যাত্রা

নারীরাও যাচ্ছেন ব্যায়াম করতে। সম্প্রতি নারিন্দার হাজী ফজলুর রহমান মহিলা শরীরচর্চাকেন্দ্রে।

এই সহস্রাব্দের শুরুতে কলকাতাকেন্দ্রিক ব্যান্ড দল চন্দ্রবিন্দু গেয়েছিল, ‘গায়ে না লাগলে গত্তি, জিমে করে দেব ভর্তি/...জিমে না গেলে হবে না ভালো ছেলে’। নিছক মজার ছলে সময়ের ধারা বদলের একটা বাঁক মূর্ত করে তোলা এই গানটি প্রকাশের পর দেড় যুগ পেরিয়েছে। এখন সবুজের স্নিগ্ধতা ঘুচে যাওয়া, মাঠ–প্রান্তরহীন ঢাকার বাসিন্দাদের অনেকে শরীর ও মনের ভারসাম্য রাখার উপায় খুঁজে নিচ্ছেন পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে ওঠা জিমগুলোর চারদেয়ালের চৌহদ্দিতে।

জিম–সংস্কৃতি ঢাকার তরুণদের কাছে এখন আগ্রহের নতুন বিষয়। অতি দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণে বিশৃঙ্খল এই শহরের বাতাসে বুকভরে শ্বাস নেওয়ার উপায় নেই। খোলা জায়গায় বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দুদণ্ড আড্ডা কিংবা খেলাধুলার পরিবেশও উধাও। এ অবস্থায় ঘরে বসে কম্পিউটার কিংবা মুঠোফোনের পর্দায় সময় কাটানো কিশোর–তরুণদের একটা বড় অংশ এখন জিমমুখী। দিনে তাঁদের নির্দিষ্ট একটা সময় কাটছে জিমের ট্রেডমিল, ক্রসট্রেনার কিংবা সাইক্লিং মেশিনে। শরীরচর্চা করতে করতেই এঁদের কেউ কেউ আবার জিমকেন্দ্রিক উদ্যোক্তাও বনে গেছেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঢাকায় জিম–সংস্কৃতির বিকাশের শুরু এক দশক আগে থেকেই। প্রথম পর্যায়ে মূলত উচ্চবিত্ত এবং তাদের অনুগামী অল্পস্বল্প মধ্যবিত্তরাই জিমের দিকে পা বাড়াতে শুরু করেন। তবে ২০১০ সালের পর থেকে জিমমুখীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পাড়া–মহল্লার এধারে ওধারে নারী ও পুরুষের আলাদা ব্যবস্থাসহ অনেক জিম গড়ে ওঠায় মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, কর্মজীবী নারী ও শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ এসবে আসতে থাকেন। এখন এই ধারায় যুক্ত হয়েছে অপেক্ষাকৃত তরুণেরা। সেই সঙ্গে বাড়ছে সব বয়সী নারীদের অংশগ্রহণ।

এই মুহূর্তে ঢাকায় জিমের সংখ্যা কত, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। যে যাঁর মতো নিজ উদ্যোগে পাড়া–মহল্লার অলিগলিসহ গুরুত্বপূর্ণ নগরকেন্দ্রগুলোতে জিম অথবা ফিটনেস সেন্টার গড়ে তুলেছেন কিংবা তুলছেন। এমনই একজন মোহাম্মদপুরের ডায়মন্ড মাল্টি জিমের স্বত্বাধিকারী দিলদার হাসান। বাংলাদেশ উশু অ্যাসোসিয়েশনের (বর্তমানে ফেডারেশন) প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক দিলদার তাঁর জিমটি গড়ে তুলেছিলেন ১৯৯৪ সালে। তিনি বলেন, ‘সে সময় মোহাম্মদপুর এলাকায় অন্য কোনো জিম ছিল না। পরে একটা–দুটো করে হলেও তার সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। তবে ২০১০ সালের পর থেকে জিমের সংখ্যা ব্যাপক বাড়তে থাকে। এখন খোঁজ নিলে এক মোহাম্মদপুর এলাকাতেই শ–খানেক জিম পাওয়া যাবে।’

>

নগরজীবনে এখন শরীরচর্চা ক্রমেই গুরুত্ব পাচ্ছে।
পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠেছে নানা রকমের জিম।
নারীদের জন্যও রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা।

২৫ বছর ধরে জিম পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত দিলদার হাসানের পর্যবেক্ষণ, ‘জিমের প্রতি কিশোর–তরুণদের আগ্রহ বাড়ার কারণেই এর সংখ্যা এমন বাড়ন্ত। এ ছাড়া মানুষ এখন অনেক স্বাস্থ্যসচেতন। শরীর ঠিক রাখতে চিকিৎসকেরাও নিয়মিত ব্যায়ামের পরামর্শ দেন। কিন্তু জায়গা ও সুবিধামতো সময়ের অভাবে অনেকে তা নিয়মিত করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে জিম একটা চমৎকার বিকল্প। কারণ এখানে নানা রকমে যন্ত্রপাতির পাশাপাশি প্রশিক্ষক থাকেন। তাঁরা বয়স–ওজন ও শরীরের সুবিধা–অসুবিধা অনুসারে ব্যায়াম নির্দিষ্ট করে দিতে পারেন। দেখভাল করতে পারেন। আর দিনের যেকোনো সময়ে এসে জিমে ঘাম ঝরানো যায়।’

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, আধুনিক জিমনেসিয়ামগুলোয় যন্ত্রপাতির অভাব নেই। কোনটার কোন কাজ, তা খালি চোখে বোঝা কঠিন। তবে ব্যায়ামের যন্ত্রগুলো দেখতে অনেকটা একই রকম হলেও প্রতিটারই কাজ আলাদা। সুসজ্জিত জিমগুলোতে গেলে চোখে পড়ে, কেউ আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে দুই হাতে ভর দিয়ে নিজের শরীরটাকে তুলে দিচ্ছেন শূন্যে। সমতল বেঞ্চে পিঠ লাগিয়ে ১৫-২০ কেজি ওজন তুলছেন অনেকে। অনেকে আবার এসব ভারী ব্যায়ামের ধারেকাছে না গিয়ে ফ্রি হ্যান্ড জোনে জিম বল দিয়ে শরীরটাকে যাচাই করে নিচ্ছেন।

শরীরচর্চায় ব্যস্ত স্বাস্থ্যসচেতন ব্যক্তিরা। সম্প্রতি ধানমন্ডির একটি জিমে। ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি পান্থপথের গোল্ডস জিমে কথা হয় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী কৌশিক দের সঙ্গে। তার সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, নিছক ব্যায়াম নয়, জিমের প্রতি তার আগ্রহ বেড়েছে পর্দার প্রিয় নায়কদের সুগঠিত শরীর দেখে। সে বলে, ‘স্কুল–কোচিংয়ে সময় দেওয়ার পর খেলাধুলার জন্য সময় বের করা কঠিন। খেলার জায়গাও তো নেই। আর বডি বিল্ডিংয়ের প্রতি আমার আলাদা আগ্রহ আছে। তাই জিমে আসি।’

শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা বহুতল ভবনের তিনতলায় আছে একটি জিম নাম—পাওয়ার জিম। জিমের ব্যবস্থাপক মুক্তাদির হোসেনের কাছ থেকে জানা যায়, এই জিমের নিয়মিত সদস্যসংখ্যা আড়াই শর মতো। এর ৭০ শতাংশই বিভিন্ন স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থী।

জিমে নারীদের ভিড় বাড়ছে
ঢাকার অনেক জিম কিংবা ফিটনেস সেন্টারে নারী–পুরুষের একই জায়গায় শরীরচর্চার ব্যবস্থা যেমন আছে, তেমন একই জিমে নারীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থাও রেখেছে অনেক কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি নারীদের জন্য বিশেষায়িত জিমের সংখ্যাও কম নয়।

শেওড়াপাড়ার গোল্ডস জিমের ব্যবস্থাপক মুক্তাদির জানান, এলাকার নারীদের চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে মাসখানেক আগে তাঁরা নারীদের জন্য আলাদা বিভাগ চালু করেছেন। এর মধ্যেই জিমটির নারী সদস্যসংখ্যা ২০ ছাড়িয়েছে। মুক্তাদির বলেন, ‘সদস্য নারীদের বেশির ভাগ গৃহবধূ। আরও অনেক নারী জিম করতে আসতে চান। তবে জায়গার অভাবে আমরা সবাইকে সদস্য করতে পারছি না।’

একই মত ব্যক্ত করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) পরিচালিত নারিন্দার হাজী ফজলুর রহমান (কালাচান) মহিলা শরীরচর্চা কেন্দ্রের প্রশিক্ষক নুরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, প্রতিদিন এই শরীরচর্চা কেন্দ্রে পাঁচটি আলাদা সেশনে দুই শর বেশি নারী ব্যায়াম করতে আসেন। ২০১০ সালে এই শরীরচর্চা কেন্দ্রটি চালুর পর থেকেই এর প্রতি এলাকার নারীদের আগ্রহ বাড়ছে। কিন্তু জায়গার অভাবে আমরা সবাইকে সুযোগ দিতে পারি না।’

নারীদের জন্য বিশেষায়িত এমন আরেকটি জিম হচ্ছে গুলশান–২ নম্বরের দ্য ড্যাজেল লিমিটেড। এ ছাড়া মালিবাগের ফিটনেস বাংলাদেশ নামের জিমে নারী–পুরুষ একই সঙ্গে শরীরচর্চা করতে পারেন। আবার সিদ্ধেশ্বরীর কমব্যাট জিম কিংবা বসুন্ধরা সিটির অ্যাডোনাইজ ফিটনেস সেন্টারে নারীদের শরীরচর্চার জন্য আলাদা বিভাগ আছে।

ফ্যাশন নয়, প্রয়োজন
বনানীর হ্যামার ফিটনেস ক্লাবের সদস্য পঞ্চাশের কোঠা পেরোনো ব্যবসায়ী রুবাইয়াত হাসান অনেকটা শখের বশেই জিমে যাওয়া–আসা শুরু করেছিলেন। এখন এটা তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রুবাইয়াত বলেন, ‘দিনে এক ঘণ্টার জন্য হলেও আমাকে জিমে আসতে হয়। প্রথম দিকে বাসায় নিজে নিজেই ব্যায়াম করতাম। কিন্তু আলসেমির কারণে মাঝেমধ্যেই বাদ পড়ে যেত। কিন্তু জিমে এসে দেখলাম আমার বয়সী অনেকেই এখানে আসছেন। এখন এটা অনেকটা নেশার মতো হয়ে গেছে।’

একটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মিলকান তারেকের ভাষ্য, ‘এই শহরের যে পরিবেশ আর যে পরিমাণ কাজের চাপ, তাতে ফিট থাকাটা খুব জরুরি। ফিট থাকার জন্য আমার চিকিৎসক আমাকে নিয়মিত হাঁটা ও সাঁতার কাটার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু এতে অনেক ঝক্কি। অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও ঘণ্টাখানেক সময় বের করে টুক করে জিমটা সেরে নেওয়া যায়। নিয়মিত জিম করার কারণে এখন শরীরটা বোঝা মনে হয় না। ঝরঝরে লাগে। পাশাপাশি মানসিকভাবেও ফুরফুরে থাকি।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, নিয়মিত জিম করার জন্য প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছার। মাসে দুই–তিন হাজার টাকার বিনিময়ে মাঝারি মানের জিমনেসিয়ামের সদস্য হওয়া যায়। তবে জিমের অবস্থান আর উপকরণভেদে টাকার অঙ্ক কম–বেশি হতে পারে।

তো অবসরের খানিকটা সময় বাঁচিয়ে শরীর নামের কারখানাটি সচল–সবল রাখার জন্য যে কেউ খুঁজে নিতে পারেন পছন্দসই জিম। যাতে ঘামের সঙ্গেই বেরিয়ে যেতে পারে মনের যত ক্লেদ, অবসাদ।

আরও পড়ুন:

জিমে শরীরচর্চার ক্ষেত্রে সতর্কতা