Thank you for trying Sticky AMP!!

কারাবন্দী বাবা শফিকুল ইসলাম কাজলের মুক্তির দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধন ও প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছেলে মনোরম পলক। গত ২৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে

বাবার জন্য এক ‘নিঃসঙ্গ শেরপার’ লড়াই

বকশীবাজারের ‘অপরাজিতা’ বাড়িটার বসার ঘর থেকে ভেতরের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল একটা পোস্টার। মোটা হরফে লাল কালিতে লেখা ‘আমার বাবা কাজলের মুক্তি চাই।’

এই কাজল কারাবন্দী ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম। আর পোস্টারের লেখাটা তাঁর ছেলে মনোরম পলকের। ঢাকা শহরের নানা প্রান্তে মনোরম এই দাবি নিয়ে দাঁড়িয়েছেন বহুবার। কিন্তু মুক্তি মেলেনি।

এ বছরের ১০ মার্চ থেকে টানা ৫৩ দিন গুম হয়ে থাকার পর শফিকুল ইসলাম কাজল এখন কারাগারে। তাঁর কারাবাসের সময়ও তিন মাস পেরোতে চলল। হুমায়ুন আজাদ কবি শামসুর রাহমানকে উপমা দিয়েছিলেন ‘নিঃসঙ্গ শেরপা’। প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও বাবার সন্ধান ও মুক্তির জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্সের ছাত্র মনোরম পলকের একার লড়াই দেখে কেন যেন মনে হয় তিনিও এক নিঃসঙ্গ শেরপা।

প্রশ্নটা আপনাদের করতে চাই, বাবা কখন ফিরবে? সুস্থভাবে ফিরতে পারবে তো?
মনোরম পলক, শফিকুল ইসলামের ছেলে

বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর গত ১১ মার্চ ফেসবুকে সন্ধান চেয়ে স্ট্যাটাস দেওয়া থেকে মনোরমের যাত্রা শুরু। এখন বই-খাতা, কলম ফেলে নিয়ম করে তিনি শহীদ মিনারে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়ান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিন মামলায় গ্রেপ্তার বাবার মুক্তির দাবিতে ভার্চ্যুয়াল আলোচনার আয়োজন করেন, পুলিশের কাছে ধরনা দেন, আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, আদালত চত্বরে ঘোরেন, দেখা পাবেন না জেনেও কারাগারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।

আগস্টের শেষ সপ্তাহে বকশীবাজারে শফিকুলদের ভাড়া বাসায় বসে কথা হচ্ছিল মনোরম পলকের সঙ্গে। আলাপে যোগ দিয়েছিলেন শফিকুলের স্ত্রী জুলিয়া ফেরদৌসী ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া একমাত্র মেয়ে মণিহার ইসলাম। মণিহারকে স্কুল থেকে বাড়িতে রেখেই ১০ মার্চ বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন শফিকুল। পরনে ছিল সাদা শার্ট আর কালচে প্যান্ট। রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ পরিবার শফিকুলের কোনো বিপদ হয়েছে বলে আঁচ করতে পারে। ততক্ষণে ফোন বন্ধ। পরদিন মনোরম পলক মা জুলিয়াকে নিয়ে যান চকবাজার থানায়। শফিকুল নিখোঁজ জানিয়ে সাধারণ ডায়েরি করেন।

তখনই তাঁরা জানতে পারেন, মাগুরার সাংসদ সাইফুজ্জামান শেখর ৯ মার্চ তাঁর বাবাসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন। রাজধানীর হাজারীবাগে ১০ মার্চ ও কামরাঙ্গীরচরে ১১ মার্চ মামলার খবর পান তারও দুই মাস পর।

শফিকুল ইসলাম

এর মধ্যেই মনোরম প্রতিদিন থানায় যাচ্ছিলেন। বারবার অনুরোধের পরও তাঁর বাবার কল রেকর্ড বা সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহে গা করছিল না পুলিশ। পরে মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড থেকে জানা যায়, শফিকুল ইসলামের শেষ কথা হয়েছিল যুবলীগের এক নেত্রীর সঙ্গে। আর খুদে বার্তার বিনিময় হয়েছিল যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় এক নেত্রীর সঙ্গে।

যুবলীগ নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া গ্রেপ্তারের পর শফিকুল যুব মহিলা লীগের কয়েকজন নেত্রীর পদ পাওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। পাপিয়ার সঙ্গে কাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ সে সম্পর্কিত একটি খবরও শেয়ার করেছিলেন। এর পরই ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতার বিরাগভাজন হন তিনি। হাতিরপুলে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা পক্ষকাল অফিসের নিচে কয়েকজনকে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। শফিকুলের মোটরসাইকেল নিয়ে টানাহেঁচড়া করতে দেখা যায় তাঁদের।

শফিকুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ আদালতকে বলে তদন্ত অব্যাহত রাখা ও তদন্তকালীন পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তাঁকে যেন জামিন দেওয়া না হয়। ওই দিনই তাঁরা তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দিয়ে দেয়। জামিনও হয় সেদিন। তারপর পুলিশ ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখায় আবার।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, শফিকুলের আইনজীবী

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ভিডিও ফুটেজটি প্রকাশ করে গত ২১ মার্চ। এক বিবৃতিতে তারা জানায়, শফিকুল সম্ভবত গুম হয়েছেন। কিন্তু মনোরম খেয়াল করছিলেন, যত দিন গড়াচ্ছে শফিকুল নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-প্রতিবাদও থিতিয়ে আসছে।

প্রায় দুই মাস পর ৩ মে শফিকুল উদ্ধার হন বেনাপোল সীমান্ত থেকে। ওই দিন ছিল মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। হাতকড়া পরিয়ে শফিকুলকে আদালতে তোলা হয় নিজ দেশে অনুপ্রবেশের অভিযোগে।

শফিকুলের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, শফিকুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ আদালতকে বলে তদন্ত অব্যাহত রাখা ও তদন্তকালীন পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তাঁকে যেন জামিন দেওয়া না হয়। ওই দিনই তাঁরা তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দিয়ে দেয়। জামিনও হয় সেদিন। তারপর পুলিশ ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখায় আবার। শফিকুল এখন কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন।

‘বাবা সুস্থভাবে ফিরতে পারবে তো’

মনোরম পলক প্রায় প্রতিদিন বাবাকে নিয়ে কিছু না কিছু লেখেন। মুক্তির দাবি জারি রাখেন তিনি। গত ২৩ আগস্ট শহীদ মিনারে সবশেষ মানববন্ধন করেছেন। ‘ফ্রি মাই ফাদার কাজল’ লেখা মাস্ক মুখে সেঁটে চৌদ্দশিকের আদলে গড়া একটি ফ্রেম নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে সেদিন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কেউ কেউ এসে দাঁড়িয়েছিলেন।

শফিকুল এখন অসুস্থ। গত ২২ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা হয়েছিল তাঁকে। সেদিন বাবার সঙ্গে কথা বলতে না পারার দুঃখে, একবার ছুঁতে না পারার বেদনায় কেঁদেছিলেন বাবা-ছেলে।

সবশেষ গত ২৭ আগস্ট মনোরম পলক তাঁর ফেসবুক পেজে লেখেন, ‘...আমরা সারা দিন একজন আরেকজন থেকে লুকিয়ে থাকি। কে কাকে জিজ্ঞেস করে বসে, বাবা কখন ফিরবে, সেই প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা কেউই হতে চাই না। কিন্তু প্রশ্ন আছে। প্রশ্নটা আপনাদের করতে চাই। বাবা কখন ফিরবে? সুস্থভাবে ফিরতে পারবে তো?’