Thank you for trying Sticky AMP!!

যে সংক্রমণ খুব জরুরি

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com

২৮ এপ্রিল! স্ত্রীকে কিছু না জানিয়েই গেলাম মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। পরিচালক (প্রশাসন) ডা. বেলাল হোসেনকে জানালাম ইচ্ছার কথা। স্যার বললেন, তুমি নিশ্চিত তো? বললাম, শতভাগ।

মেসেজটা পেলাম ইফতারের আগেই। মুগদা হাসপাতালে আমার পোস্টিং হয়েছে। সরকারি ডাক্তার হিসেবে শিক্ষাছুটিতে একটা নন–ক্লিনিক্যাল কোর্সে ছিলাম। লকডাউনে তেমন কাজ না থাকায় হতাশা লাগছিল। এবার আমার কঠিন পরীক্ষা, স্ত্রীকে জানানো। তান্নিকে খবরটা দিলাম। বললাম, ‘তোমার সমর্থন চাই।’ অল কোয়ায়েট ইন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট! চোখের পানি মুছে কিছুক্ষণ পর সে বলল, ‘মানুষের সেবা করার সুযোগ পেয়েছ। আমি পাশে আছি।’ হাঁপ ছাড়লাম। তান্নি চিকিৎসক না হয়েও পেশাটির মহত্ত্ব বোঝে।

একটু পরই ফোনে শাশুড়ির কান্না, ‘বাবা, তোমাকে চাকরি করতে হবে না। ছেড়ে দাও।’ তাঁকে বোঝালাম, ‘মৃত্যুর ভয়ে চিকিৎসকের দায়িত্ব থেকে সরে এলে যে মাথা উঁচু করে আর কখনো দাঁড়াতে পারব না। আপনি শুধু দোয়া করবেন।’ তিনি শান্ত হলেন। এবার সেজ ভাইয়ার ফোন। ভেজা গলায় বললেন, ‘আল্লাহ্ করোনা রোগীদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন। তিনিই তোকে সুস্থ রাখবেন।’এক চিকিৎসক বন্ধু নিজের সংগ্রহ থেকে একটা এন-৯৫ মাস্ক পাঠাল। চিকিৎসক বড় ভাইয়া খুলনা থেকে পাঠাল দুই সেট পিপিই। আরেক স্কুলবন্ধু দিল মাস্ক আর ফেসশিল্ড। এবার আমি প্রস্তুত।

প্রথম দিন মর্নিং ডিউটি। আমাদের টিম লিডার সহকারী অধ্যাপক ওমর ফারুক ব্রিফ করলেন কীভাবে কাজ করব। এর মধ্যেই রুমের বাইরে থেকে একজনের কান্নার আওয়াজ। বেরিয়ে দেখি, এক রোগীর আত্মীয়। তাঁদের ছয় মাসের বাচ্চা রোগীর তীব্র শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। দ্রুত পিপিই পরে ছুটলাম। ডিউটি নার্সকে ডেকে ইনজেকশনের ব্যবস্থা করলাম। মাস্ক দিয়ে হাই ভলিউমে অক্সিজেন দিলাম। করোনা রোগীর খুব কাছে যেতে বিধিনিষেধ আছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে কি এত কিছু মাথায় থাকে?

সেদিন একটুর জন্যও বসতে পারিনি। বারবার ডাক আসছিল। হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় বাচ্চার বাবা এসে মোবাইল নম্বর চাইলে সেটি না দিয়েই চলে আসি। ভেবেছিলাম, একটু পরপরই ফোন আসবে। কে জানত, এই কারণে আমার মনে সারা জীবনের ক্ষত তৈরি হয়ে থাকবে। পরদিন ডিউটির এক ঘণ্টা আগেই হাসপাতালে পৌঁছে বাচ্চাটির খোঁজ নিতে গেলাম। যে উত্তর শুনলাম, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আজ সকালেই বাচ্চাটি মারা গেছে। মনে হলো, নিজের সন্তান হারালাম।

এক দিন পর ছিল ইভিনিং শিফট। একজন লোক ডক্টরস রুমের খুব কাছে এসে হাতজোড় করে গর্ভবতী স্ত্রীর জন্য তীব্র আকুতি জানাচ্ছিলেন। স্বজনেরাই রোগীকে ট্রলিতে ঠেলে সরাসরি নিয়ে এসেছেন। ৪০ সপ্তাহের পূর্ণ গর্ভবতী এবং করোনার রোগী। হাসপাতালের গাইনি টিম এল। মাত্র আধ ঘণ্টার নোটিশে অস্ত্রোপচারে বাচ্চাটি পৃথিবীতে এল। কিন্তু রোগীর ছিল গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস। অস্ত্রোপচারের পর ডায়াবেটিসের মাত্রা অনেক বেড়ে গেল। ওদিকে বাচ্চাটিও পর্যাপ্ত শ্বাস নিচ্ছে না। মা আর বাচ্চাটিকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে আমাদের সে কী প্রাণান্ত চেষ্টা! এবার ফিরে আসার সময় রোগীর স্বামীকে মনে করে মোবাইল নম্বরটা দিয়ে এলাম।

‌দ্বিতীয় নাইট ডিউটিতে হাসপাতালে ঢুকেছি ২০ মিনিট দেরিতে। দ্রুত পিপিই পরে চলে গেলাম এক রোগীর কেবিনে। অক্সিজেন মেপে দেখলাম, আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে। আইসিইউতে যোগাযোগ করলাম। বেড ফাঁকা নেই। পরম করুণাময়ের নামে চিকিৎসা শুরু করলাম। নানা চেষ্টার পর অক্সিজেনের পরিমাণ স্বস্তিকর জায়গায় এল।

কেবিন থেকে বেরিয়ে আসার সময় কানে এল, রোগীর স্ত্রী রোগীকে রাতে কী খাওয়াবেন, তা নিয়ে চিন্তিত। আমি বললাম, আপনাদের আপত্তি না থাকলে সাহ্‌রির জন্য আমার স্ত্রীর রান্না করা ফ্রায়েড রাইস পাঠাতে পারি। একটু চুপ করে থেকে তাঁরা রাজি হলেন। আমি ওয়ার্ড বয়কে আমার হটপটটা পাঠিয়ে দিলাম। এক দিন সাহ্‌রি না খেয়ে রোজা রাখলে কী আর এমন হবে! গভীর রাতে রোগীকে দেখতে গিয়ে অবাক। করোনার ভয়ে ক্রিটিক্যাল এই রোগীকে একা কেবিনে ফেলে স্ত্রী আর মেয়ে গায়েব!

করোনা সত্যিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, আমাদের মানবতা কোথায় এসে ঠেকেছে। এই সময়ে আমাদের মধ্যে যেটা বেশি সংক্রমিত হওয়া দরকার, তার নাম মানবিকতা। দোষারোপের সময় এটা নয়। সবাই শুধু একটু মানবিক হই।