Thank you for trying Sticky AMP!!

১৭ একর জমিতে ৬০ বছরের সমস্যা

  • ১৯৬০-৬১ সালে কলাবাগান, কাঁঠালবাগান ও শুক্রাবাদ এলাকার ৯৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল।

  • শেষ পর্যন্ত সরকার প্রায় সোয়া ৪ একর জমি দখলে নেয়। ৭৫ দশমিক ১৯ একর জমি অধিগ্রহণ থেকে অবমুক্ত করে।

  • বাকি প্রায় ১৭ একর জমি দখলেও রাখেনি, অবমুক্তও করেনি।

  • ২০০৯ সাল থেকে হঠাৎ ওই ১৭ একর জমির খাজনা (ভূমি উন্নয়ন কর) নেওয়া বন্ধ করে দেয় ভূমি অফিস।

চাইলেও বৈধভাবে জমি কেনাবেচা বা ফ্ল্যাটের নিবন্ধন করতে পারছেন না রাজধানীর কলাবাগান, কাঁঠালবাগান ও শুক্রাবাদ এলাকার কিছু অংশের মানুষ। এমনকি ওয়ারিশদের মধ্যে সম্পত্তিও বণ্টন করতে পারছেন না তাঁরা। মূলত গ্রিন রোডসংলগ্ন সরকারি ডরমিটরির (আবাসিক ভবন) আশপাশের প্রায় ১৭ একর জমির বাসিন্দারা এই সমস্যায় পড়েছেন। সেখানে এখন আবাসিক ও বাণিজ্যিক মিলে শতাধিক বহুতল ভবন রয়েছে। থাকেন ৩০ হাজারের বেশি মানুষ।

জমি-ফ্ল্যাট কেনাবেচাসংক্রান্ত এই সমস্যার শুরুটা পাকিস্তান আমলে, ৬০ বছর আগে (১৯৬০-৬১ সালে)। তখন ওই জমি সরকারি একটি প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু পরে প্রকল্পের কাজে তা ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে অধিগ্রহণ থেকে ওই জমি অবমুক্তও করা হয়নি। আবার সরকার নিজের দখলেও জমি রাখেনি। ফলে অধিগ্রহণের জন্য যাঁদের কাছ থেকে জমি নেওয়া হয়েছিল, তাঁদের দখলেই তা রয়ে যায়।

কলাবাগান-কাঁঠালবাগান-শুক্রাবাদ এলাকার কিছু অংশের মানুষ জমি কেনাবেচা বা ফ্ল্যাটের নিবন্ধন করতে পারছেন না।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮৪ সালে বিষয়টি নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি সভা হয়। তখন কিছু সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। এর মধ্যে ২০০৯ সাল থেকে হঠাৎ ওই ১৬ একর জমির খাজনা (ভূমি উন্নয়ন কর) নেওয়া বন্ধ করে দেয় ভূমি অফিস। মূলত এরপর থেকেই বৈধভাবে সেখানে জমি কেনাবেচা বন্ধ হয়ে গেছে। একই সঙ্গে ওই জমিতে (প্রায় ১৭ একর) নতুন ভবন তৈরি বা জমি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। রাজউক থেকে ভবন নির্মাণের অনুমোদন নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে হিস্যা বণ্টন (নামজারি) ও ফ্ল্যাটের নিবন্ধন (দলিল) করা নিয়ে। এর কারণ, এসব কাজের জন্য ভূমি উন্নয়ন করের রসিদ দেখাতে হয়।

দিন যত গড়াচ্ছে, ওই সব জমিতে উত্তরাধিকারের সংখ্যা বাড়ছে, সমস্যাও প্রকট হচ্ছে। ভুক্তভোগীদের একজন আবুল কাশেম খান। তিনি জানান, ১৯৫৫ সালে তাঁর মা নাসিরা বেগমের নামে কলাবাগান এলাকায় প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ জমি কেনা হয়েছিল। ২০০৬ সালে তাঁর মা মারা গেছেন, রেখে গেছেন ছয় সন্তান। কিন্তু এই জমির খাজনা নেওয়া বন্ধ থাকায় ভাইবোনদের মধ্যে জমি ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে পারছেন না। তিনি জানান, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, শুক্রাবাদ এলাকায় প্রায় ৩০০ জমিমালিক (পাকিস্তান আমলের) এমন সমস্যায় রয়েছেন। তাঁদের উত্তরাধিকার যোগ করলে এখন এসব জমিমালিক হাজারের বেশি হবেন।

বহু দেনদরবার, সমাধান নেই

২০০৮ সাল পর্যন্ত দলিলমূলে ওই প্রায় ১৭ একর জমির মালিকেরা নিয়মিত খাজনা পরিশোধ করতে পেরেছেন। কিন্তু ২০০৯ সালে তহশিল অফিসে খাজনা দিতে গেলে সেখান থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, জমির মালিকানা নিয়ে সমস্যা আছে, তাই খাজনা নেওয়া হবে না। যদিও পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস-সংযোগের বিল পরিশোধে সমস্যা হচ্ছে না। এমনকি সিটি করপোরেশনও গৃহকর নিচ্ছে। খাজনা নিয়ে জটিলতা নিরসনে ভুক্তভোগীরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বহু দেনদরবার করেছেন, কিন্তু সমাধান হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এবং এ-সংক্রান্ত পুরোনো কিছু নথি থেকে জানা গেছে, ১৯৬০-৬১ সালে একটি প্রকল্পের আওতায় সরকারি স্টাফ কোয়ার্টার করার জন্য কলাবাগান, কাঁঠালবাগান ও শুক্রাবাদ এলাকার ৯৬ দশমিক ১৬ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পূর্ত বিভাগ। অধিগ্রহণ করা জমির মধ্যে ৩৯ দশমিক ৫৫ একর জমি বুঝে নিয়েছিল পূর্ত বিভাগ, কিন্তু মাত্র ৩ দশমিক ৪৯ একর জমি ব্যবহার করেছিল। ফলে অব্যবহৃত বাকি জমি বিভিন্ন ব্যক্তির দখলে চলে যায়, কেউ কেউ সেই জমি নিজের নামে দলিলও করে নেন। তখন এসব জমির মূল মালিকদের অনেকেই যথাযথ ক্ষতিপূরণও পাননি।

প্রকল্পটি নেওয়ার চার বছর পর তা সংশোধন করে তৎকালীন পূর্ত বিভাগ। সরকারি পুরোনো নথির তথ্য অনুযায়ী ১৯৬৫ সালে পূর্ত বিভাগ একটি স্মারকের মাধ্যমে প্রথমে অধিগ্রহণ করা ৯৬ দশমিক ১৬ একর জমির মধ্যে মাত্র ৪ দশমিক ১৯ একর জমি প্রকল্পের জন্য রাখে, যেখানে এখন গ্রিন রোড সংলগ্ন সরকারি ডরমিটরিটি রয়েছে। বাকি ৯১ দশমিক ৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ থেকে অবমুক্ত করার সুপারিশ করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ২০ দশমিক ৯৭ একর জমি প্রকল্পের জন্য রেখে বাকি ৭৫ দশমিক ১৯ একর জমি অধিগ্রহণ থেকে অবমুক্ত করা হয়। কিন্তু ওই সময় বাস্তবে পূর্ত বিভাগ দখল নিয়েছিল ৪ দশমিক ১৯ একর জমির। বাকি ১৬ দশমিক ৭৮ একর জমি বিভিন্ন ব্যক্তির দখলে ছিল। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এখন যে খাজনা নেওয়া হচ্ছে না, এটি মূলত এই ১৬ দশমিক ৭৮ একর একর জমির।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই জটিলতা নিরসনে ১৯৮৩ সালে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে একটি কমিটি করা হয়। এরপর ১৯৮৪ সালে তৎকালীন ভূমিমন্ত্রী এম এ হকের সভাপতিত্বে আন্তমন্ত্রণালয় সভা হয়েছিল। এই সভার একটি কার্যবিবরণী প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে। এই কার্যবিবরণীতে প্রায় ১৭ একর জমি নিয়ে জটিলতার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।

কার্যবিবরণী অনুযায়ী, বিষয়টি নিয়ে মামলাও হয়েছিল। আদালত জমির মূল মালিকদের পক্ষেই রায় দিয়েছেন। আন্তমন্ত্রণালয় সভায় ওই জমি সালামির (ওই সময়ের বাজারদর অনুযায়ী) বিনিময়ে মূল মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে কেউ সালামি দিতে রাজি না হলে জমি পূর্ত বিভাগকে দখলে নিতে বলা হয়েছিল। এ সিদ্ধান্তের পর প্রায় ৩৬ বছর পার হয়েছে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা মোরশেদ চৌধুরী বলেন, কলাবাগান প্রথম লেনে এক সারিতে ২০-২৫টি বাড়ি আছে। সব কটি বাড়িই চার-পাঁচতলা। প্রতিটি বাড়ির জমি নিয়ে খাজনার সমস্যা রয়েছে। তিনি বলেন, তাঁর এক আত্মীয় এমন জমিতে ২২টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করে সব কটিই বিক্রি করেছেন। কিন্তু যাঁরা কিনেছেন, তাঁরা নিজেদের নামে ফ্ল্যাটের দলিল করতে পারেননি।

ভুক্তভোগীদের একজনের জমি কলাবাগান লেক সার্কাসে। সেখানে এখন দোতলা ভবন রয়েছে। সত্তরের দশকে ডিআইটি (বর্তমান রাজউক) থেকে নকশা অনুমোদন নিয়ে ভবনটি নির্মাণ করা হয়। খাজনা দিতে না পারায় এই ভবন পুনর্নির্মাণ করা যাচ্ছে না।

কলাবাগান এলাকাটি পড়েছে ধানমন্ডি মৌজায়। ধানমন্ডি সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) রবিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এ রকম সমস্যা নিয়ে প্রায়ই তাঁর কাছে স্থানীয় লোকজন আসেন। প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ওই এলাকায় জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। এখন আরেকটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অধিগ্রহণ থেকে জমি অবমুক্ত না করা পর্যন্ত খাজনা নেওয়া বা নামজারির কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারাও অবগত আছেন। তাঁর আশা, শিগগিরই এর একটি সমাধান হবে।