Thank you for trying Sticky AMP!!

মাঠটি রক্ষা পেলে সব ভুলে যাব

কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার আন্দোলনে নেমে ১৩ ঘণ্টা থানায় আটক ছিলেন সৈয়দা রত্না ও তাঁর কিশোর ছেলে। সৈয়দা রত্না মাঠ রক্ষার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও থানায় আটক থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ

সৈয়দা রত্না
প্রশ্ন

প্রথম আলো: মাঠটি রক্ষার আন্দোলনে আপনি কীভাবে ও কেন যুক্ত হলেন?

সৈয়দা রত্না: আমার পরিবার কলাবাগানের এই এলাকায় বাস শুরু করে ১৯৭১ সালের দিকে। এই পাড়ায়ই আমাদের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। তেঁতুলতলা মাঠ আগে আরও বড় ছিল। এখন ছোট হয়ে গেছে। আমার সন্তানেরাও এই মাঠে খেলে বড় হয়েছে। আমাদের ওয়ার্ডে প্রায় তিন লাখ মানুষ বাস করেন। তাঁদের সবার জন্য একমাত্র উন্মুক্ত স্থান ও খেলার মাঠ এই তেঁতুলতলা।

২০২০ সালের শুরুর দিকে হঠাৎ একদিন দেখলাম মাঠের দুই পাশের দেয়ালে পোস্টার সাঁটানো। তাতে লেখা, সেখানে নাকি থানা ভবন নির্মিত হবে। আশপাশে এত ভবন থাকতে এলাকার এই একমাত্র মাঠে কেন থানা ভবন করতে হবে? আমি শুধু একা নই, এলাকার কেউ এটা মেনে নিতে পারেননি। আমিসহ অনেকে সঙ্গে সঙ্গে ওই ঘটনার প্রতিবাদে নামি। আমার স্বামী ২০১৩ সালে মারা যান। তাঁর জানাজা হয়েছিল এই মাঠে। এলাকায় যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগের জানাজা হয়েছে মাঠটিতে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: তার মানে এটি শুধু খেলার মাঠ নয়, জায়গাটি সামাজিক কাজেও ব্যবহৃত হয়।

সৈয়দা রত্না: মাঠটিতে ঈদের নামাজ হয়। প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান হয় এই মাঠে। সকালে এলাকার তরুণেরা সেখানে ব্যায়াম করে। ফুটবল খেলে। এলাকায় দুটি বস্তি আছে। সেখানকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা ও সচ্ছল পরিবারের সন্তানেরা সেখানে একসঙ্গে খেলাধুলা করে। বিকেলে এলাকার নারী-পুরুষেরা মাঠটিতে গিয়ে গল্প করে। তাই মাঠটি ভবন করে শেষ করে দেওয়া হবে, সেটি আমি মানতে পারিনি। তাই দুই বছর আগে আমিসহ কয়েকজন মিলে এই মাঠ রক্ষার আন্দোলনে নামি। আমি একজন অতি ক্ষুদ্র মানুষ। আমার শক্তিও অনেক কম। তবুও অনেকটা সময় আমিসহ অনেকে মিলে আন্দোলনটি টেনে নিয়ে গেছি। কলাবাগানের অলিগলিতে মাইকিং করেছি। এলাকার শিশুরাও তাদের প্রাণের মাঠটি রক্ষায় কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছে। এলাকার মসজিদ থেকে এসে প্রায় প্রতি শুক্রবার মুসল্লিরা সমাবেশ ও কর্মসূচি পালন করেছেন। ফলে আমি বলব, এই মাঠ রক্ষা করা এলাকার তিন লাখ মানুষের প্রাণের দাবি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তো আপনারা সরব ছিলেন?

সৈয়দা রত্না: এই মাঠ রক্ষার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম (মঞ্চ) হিসেবে আমরা ফেসবুকে একটি পেজ খুলেছি। সেখানে এই আন্দোলনের সব কর্মসূচির হালনাগাদ তথ্য ও ভিডিও রয়েছে। সংবাদমাধ্যমে আমাদের আন্দোলন নিয়ে যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তা–ও আমরা সেখানে দিয়েছি। মাঠটি রক্ষায় যতটুকু আমাদের পক্ষে সম্ভব, তা আমরা করেছি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আপনাকে পুলিশ কেন আটক করে থানায় নিয়ে যায়? আপনার ছেলেকেও তো থানায় নেওয়া হয়।

সৈয়দা রত্না: চলতি মাসের শুরু থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম মাঠে ভবন নির্মাণের জন্য চারপাশে দেয়াল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। পাইলিংয়ের জন্য গর্ত করা হয়েছে। এরপর আমরা এলাকার নারীরা একত্র হয়ে সন্তানদের একমাত্র খেলার মাঠ রক্ষায় একযোগে নেমে পড়ি। আমরা পাইলিংয়ের জন্য করা গর্ত আবার মাটি ফেলে ভরাট করে প্রতিবাদ জানাই। এরপরও পুলিশ আবারও যখন জোর করে নির্মাণকাজ শুরু করে, তখন আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভে গিয়ে প্রতিবাদ জানাই। আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের আর তো কিছু করার ছিল না। অসহায় অবস্থায় আমি দেশের মানুষের কাছে মাঠটি রক্ষার জন্য শেষ চেষ্টা হিসেবে আবেদন জানাই। এর পরপরই সকাল সাড়ে নয়টার দিকে আমাকে পুলিশ বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। প্রথমে থানায় নিয়ে হাজতে রাখে। বাসায় আমার ছেলে একা ছিল, তার জন্য আমার টেনশন হচ্ছিল। আমি হাজতে পায়চারি করছিলাম। একজন কনস্টেবলকে হাজতে থাকা ফ্যানটি ছাড়তে বলি। তাঁরা তখন আমাকে হাজত থেকে বের করে একটি কক্ষে নিয়ে বসিয়ে বলেন, ‘এখানে ফ্যান আছে। আপনি এখানে বসেন।’ এর কিছুক্ষণ পর দেখি আমার কিশোর ছেলেকে পুলিশ আটক করে নিয়ে এসেছে। মা-ছেলের মধ্যে কোনো কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাঁরা আমার ছেলেকে হাজতে আর আমাকে একটি কক্ষে আলাদা করে রাখেন। আমি পুরো সময় ছেলের জন্য সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করেছি। এ–ও ভেবেছি, তাহলে কি মাঠটি আর রক্ষা করতে পারব না?

প্রশ্ন

প্রথম আলো: মাঠটি রক্ষার আশা কি এখন ছেড়ে দিয়েছেন?

সৈয়দা রত্না: থানা থেকে ছাড়া পাওয়ার পর যখন জানতে পারি দেশের লাখো মানুষ এই মাঠ রক্ষার আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছে, দেশের গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ, পরিবেশবাদী সংগঠন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই মাঠ রক্ষার আন্দোলনে একাত্মতা জানিয়েছেন, তখন মনে আশা জেগেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বিকল্প জায়গা খোঁজার কথা বলেছেন। কোথাও একটি ভবন নিয়ে সেখানে থানা করলেই তো হয়।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: পুলিশ আপনাকে ছেড়ে দেওয়ার সময় কী বলেছে?

সৈয়দা রত্না: যতটুকু মনে আছে, তারা একটি কাগজে লিখেছে, ‘আমি আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে থানার ভবন নির্মাণের ভিডিও প্রচার করব না। সরকারি কাজে বাধা দেব না।’ আমি তাতে সই দিয়ে থানা থেকে ছাড়া পেয়েছি।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এখন আপনি কী করবেন, কী চান?

সৈয়দা রত্না: দুই বছর ধরে আমি মাঠটি রক্ষার জন্য যে আন্দোলন করেছি, তা ব্যর্থ হতে পারে না। আমি মনে করি, সরকার তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে, মাঠটি এলাকাবাসীর জন্য ছেড়ে দেবে। মাঠটি রক্ষা পেলেই আমি সবকিছু ভুলে যাব।