Thank you for trying Sticky AMP!!

বেইলি রোডে পুড়ে যাওয়া সাততলা ভবন। আজ শুক্রবার সকালে

কেউ ভবন থেকে, কেউ তার বেয়ে নিচে লাফিয়ে পড়েন

রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজে ইংরেজিতে স্নাতক (সম্মান) করছেন আফজাল হোসেন (১৯)। প্রযুক্তিবিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠানে বিক্রয়কর্মীর কাজ করে পড়াশোনার খরচ জোগান। গতকাল বৃহস্পতিবার বেইলি রোডের বহুতল ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় প্রাণ বাঁচাতে চারতলা থেকে লাফিয়ে পড়েন তিনি। এখন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অরেঞ্জ ইউনিটে চিকিৎসাধীন।
আফজালের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায়। গতকাল রাত পৌনে ১০টার দিকে বহুতল ওই ভবনের নিচতলা থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়লে মারা যান ৪৬ জন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১১ জন অরেঞ্জ ইউনিটে চিকিৎসাধীন।

চার তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে বেঁচে যান আফজাল হোসেন। শুক্রবার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে

আজ শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে চিকিৎসাধীন আফজাল এই প্রতিবেদককে জানান, আগুন, ধোঁয়া ও একের পর এক মানুষকে মারা যেতে দেখে তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর মতো আরেক শিক্ষার্থী সহকর্মী আসিফ মারা যান। তিনি সিঁড়ি বেয়ে চারতলায় উঠে যান। ছাদের দরজা বন্ধ থাকতে পারে এই ভয়ে ছাদে যাননি। আর আগুন–কালো ধোঁয়ায় নিচে নামার কোনো উপায় ছিল না। যেদিকে যান কালো ধোঁয়া। পরে চারতলায় হাত দিয়ে থাই গ্লাস ভেঙে ওপর থেকে লাফ দেন। তাঁর আগে আরও কয়েকজন লাফিয়ে পড়েন। আফজাল জানান, নিচে পড়ার পর তাঁর আর কিছুই মনে নেই। এখন তাঁর কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা। শরীর নাড়াতে পারছেন না। থাই গ্লাস ভাঙার কারণে হাত কেটে গেছে।

আফজালের পাশের শয্যায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন আগুন লাগা ভবনের ছয়তলায় অবস্থিত জেস্টি রেস্তোরাঁর শেফ জহিরুল ইসলাম (২৮)। তিনি জানান, ৬ মাস আগে তিনি জেস্টিতে যোগ দেন। কাজ করার সময় পোড়া গন্ধ পান এবং নিচ থেকে মানুষের হইচই শুনতে পান। আগুন লেগেছে জানার পর তিনি সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে যান। আগুনের তাপে চারপাশ গরম হয়ে উঠেছিল। কালো ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ছাদ থেকে তাঁকে উদ্ধার করেন।
লাফিয়ে পড়ে আহত কাজী নওশাদ আনান (২১) নামের এক শিক্ষার্থী ওই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। ওয়ার্ডের বাইরে নওশাদের বাবা কাজী তসলিম উদ্দিন জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর ছেলের। এর আগে তাঁর ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে গতকাল ওই ভবনের একটি রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন। তাঁরও যাওয়ার কথা ছিল। একটি কাজে আটকে যাওয়ায় তিনি যেতে পারেননি। ছেলে তাঁকে বলছিলেন, ‘আব্বু, মনে হচ্ছিল কেয়ামত এসেছে। এখানে–সেখানে মানুষ মরে পড়ে আছে।’ বাবা জানান, তাঁর ছেলে পাঁচতলা থেকে একটি তার বেয়ে নিচে নামার চেষ্টা করেন। নিচ থেকে দেড়তলা সমান জায়গা বাকি থাকতে তারটি দৈর্ঘ্যে শেষ হয়ে যায়। ওই উচ্চতা থেকে তাঁর ছেলে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে আহত হন। কোমরে ব্যথা পেয়েছেন। শ্বাসকষ্টও রয়েছে।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অরেঞ্জ ইউনিটের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক প্রদীপ চন্দ্র দাস প্রথম আলোকে বলেন, বেইলি রোডের বহুতল ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়ায় এত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গতকাল দিবাগত রাতে যে ১০ জন মৃত ব্যক্তিকে পাওয়া গেছে, তাঁদের পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তাঁরা আগুনে না পুড়লেও বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। এই ইউনিটে চিকিৎসাধীন ১১ জনের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, তাঁদের নিশ্বাসের সঙ্গে কার্বন মনোক্সাইড দেহে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে কেউ কেউ বাঁচার জন্য ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন।

আগুন লাগার খবর পেয়ে সিঁড়ি বেয়ে ভবনের ছাদে উঠে পড়েন জহিরুল ইসলাম। শুক্রবার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে

ভবনগুলো সুপ্ত বোমা হয়ে গেছে

১ মার্চ বড় মেয়ের জন্মদিন পালন উপলক্ষে আগের দিন দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে জেস্টি নামের রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং প্রতিষ্ঠানটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান। আহমেদ কামরুজ্জামান আজ সকালে এই প্রতিবেদককে বলেন, ছাদে চলে যাওয়ায় তাঁরা প্রাণে বেঁচে গেছেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান এখনো ভীত হয়ে আছে। পরিচিত চিকিৎসকদের কাছ থেকে মুঠোফোনে ওষুধ নিয়েছেন তাঁরা। তিনি বলেন, ‘বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে বলে নাকে গন্ধ আসার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারি এটা সিনথেটিক পোড়া গন্ধ। রেস্তোরাঁর লোকেরা বলছিল, অনেক রেস্তোরাঁ রয়েছে। এটা রান্নার গন্ধ। আমি তাঁদের ধমকে গ্লাসের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকজন ভবনের দিকে আঙ্গুল তুলে চিৎকার করছে। থাই গ্লাস হওয়ায় ভালো করে শোনা যাচ্ছিল না। আগুন বুঝতে পারার পর কোনো দ্বিধা ছাড়া পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছাদের দিকে রওনা দিই। ভাগ্যক্রমে ছাদের দরজা খোলা ছিল। তিনি বলেন, ভবনটিতে অনেক রেস্তোরাঁ। কমপক্ষে ৫০টির মতো গ্যাস সিলিন্ডার ছিল সিঁড়ি, করিডোর ও রান্নাঘরগুলোয়। এ রকম কাঁচঘেরা একটি ভবনে অনেক রেস্তোরাঁ, গ্যাস সিলিন্ডার সব মিলিয়ে পুরো ভবনটি সুপ্ত বোমা হয়ে গেছে। ওই ভবনে তিতাসের গ্যাস সংযোগ আছে কি না, তিনি নিশ্চিত নন।