Thank you for trying Sticky AMP!!

সংবিধানের মূলনীতিতে গড়তে হবে রাষ্ট্র

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের সঙ্গে মিশে আছে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীরও রক্ত। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মনিবেদনে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী ভাবনা তাঁদের সন্তানদের? তাই নিয়ে এই আয়োজন।

কাজী শাহেদুল হালিম

ঘরের দেয়ালে টাঙানো সমাবর্তনের ক্যাপ পরা বাবার একমাত্র ছবিটি ছাড়া তাঁর আর কোনো স্মৃতি আমার কাছে নেই। মাত্র ১০ মাস বয়সে বাবাকে হারিয়েছি, তাঁর স্নেহ-আদর পাইনি। বড় হয়ে মা, নিকট আত্মীয়স্বজন আর বাবার ছাত্রদের কাছ থেকে জেনেছি যে তিনি খুব সাহসী, পরোপকারী ও বিপ্লবী চেতনার মানুষ ছিলেন।

বাবার জন্য অনেক কষ্ট হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা তাঁর আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল, এ কথা ভাবলে গর্বে বুক ভরে ওঠে। বাবার মতো লাখো শহীদের রক্তে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পেয়েছি। আমাদের শপথ নিতে হবে, লাখো শহীদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। কোনো অশুভ শক্তিই যেন মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে মুছে দিতে না পারে।

লাখো শহীদ যে মূল্যবোধ ও আদর্শ ধারণ করে দেশের মুক্তির লক্ষ্যে তাঁদের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, তা পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন করতে রাষ্ট্র, সমাজ ও আপামর জনসাধারণকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য আর সহনশীল রাজনৈতিক পরিবেশ। মুক্তিযোদ্ধারা যে আদর্শ, দেশপ্রেম ও একতা নিয়ে বর্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, তা বাস্তবায়নে রাষ্ট্র ও সমাজকে আরও একাত্ম হয়ে কাজ করতে হবে।

আমাদের বাড়ি নওগাঁ জেলায়। বাবা শহীদ কাজী আ. জব্বার ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে ১৯৬৩ সালে নওগাঁর নজিপুর উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এলাকায় তিনি খুবই জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনে নওগাঁয় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে মার্চেই বাবা তাঁর কয়েকজন রাজনৈতিক সহযোদ্ধাকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাঁরা নওগাঁর বিভিন্ন স্থানে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। তাঁদের সর্বশেষ যুদ্ধক্ষেত্র ছিল ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার আগ্রাদ্বিগুন এলাকা। বিজয়ের উষালগ্নে ৬ ডিসেম্বর যুদ্ধের একপর্যায়ে হানাদারদের ছোড়া গ্রেনেডে শহীদ হন বাবা। সহযোদ্ধারা তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে সীমান্তের ওপারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান বালুরঘাট এলাকায় দাফন করেন।

মুক্তিযুদ্ধে বাবা যখন শহীদ হন, আমার বড় ভাইয়ের বয়স তখন ছয় বছর, মেজ ভাইয়ের তিন বছর আর আমার ১০ মাস। বাবা শহীদ হওয়ার পর মা অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আমাদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। মা ইন্তেকাল করেন ২০০৪ সালে।

বাবার কবর এখনো ভারতের বালুরঘাট এলাকায় রয়ে গেছে। যে দেশের জন্য তিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেই দেশে তাঁর অন্তিমশয্যা হয় না! বাবার কবর দেশের মাটিতে থাকলে তাঁর কবরটা জিয়ারত করতে পারতাম! এখনো আমরা প্রত্যাশা করি, বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের পারস্পরিক সহযোগিতায় বাবার মরদেহ একদিন এ দেশের মাটিতে আনা সম্ভব হবে। স্বাধীন দেশের মাটিতেই তিনি শায়িত থাকবেন।

আমি মনে করি গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র—আমাদের সংবিধানের এই চার মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে আমরা একটি উন্নত রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারলেই লাখো শহীদের আত্মত্যাগ সফল হবে।

ড. কাজী শাহেদুল হালীম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী কাজী আ. জব্বারের পুত্র