Thank you for trying Sticky AMP!!

আবার সব স্বাভাবিক হবে?

প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

মাত্র ছয় মাস আগেও আমাদের মধ্যে অনেকেরই মনে হতো পৃথিবীটা অমানবিক, অসহ্য আর বৈষম্যে ভরা। অথচ আজ সেই আমরাই অস্থির হয়ে ভাবছি, আবার কবে সব স্বাভাবিক হবে? 'স্বাভাবিক' শব্দটা বেশ গোলমেলে। ‌'স্বাভাবিক'–এ ফেরা মানে আগের নিয়মে ফিরে যাওয়া। সত্যি কি তা–ই সম্ভব?

কোভিড-১৯ এক অদ্ভুত চক্রে আটকে ফেলেছে আমাদের, এ সম্বন্ধে চিকিৎসক বা গবেষকদের ধারণাই ছিল না একেবারে। এর আক্রমণে মানবদেহের সব রক্তনালির দেয়ালের বিপর্যস্ততা, রক্তে অক্সিজেনের অভাব, রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ার গোলমাল আর একে একে সব অরগান বা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের বৈকল্য নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাওয়াকে রোধ করতে পারছে না অনেকে। তার সঙ্গে আছে সাইটোকাইন স্টর্ম বা রোগ প্রতিরোধক্ষমতার সৃষ্ট ঝড়। তার চেয়ে বড় কথা চিকিৎসকেরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করছেন যে চিকিৎসাপদ্ধতির চিরন্তন অ্যালগরিদম কোনো কাজে তো আসছেই না বরং হিতে বিপরীত হয়ে দেখা দিচ্ছে।

সাইটোকাইন স্টর্ম থামাতে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন বা অক্সিজেন মাত্রা বাড়াতে ভেন্টিলেটর, কোনো কিছুই যেন অঙ্ক মেলাতে পারছে না। ফলে কোনো দিকে দিশা না পেয়ে আমরা এক মহা স্থবির সময়ে আটকে পড়েছি, যে আটকে পড়া সময়ের মূল্য গুনতে হবে অনেক চড়া দামে। এই মহামূল্যবান সময়ের মধ্যে আমাদের ভাবতে হচ্ছে কীভাবে একটা জুতসই অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ কাজে লাগানো যায়, কী উপায়ে দ্রুততম সময়ে একটা কার্যকর টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব অথবা এই অক্সিজেন স্বল্পতাকেই বা কীভাবে সামাল দেওয়া সম্ভব। এই অপরিসর সময়ে আমাদের সামাজিক আর মেডিকেল রেসপন্সকেও একেবারে পুরো নতুন করে ওরিয়েন্টেশন আর ফোকাস করতে হচ্ছে একই সঙ্গে। সব মিলিয়ে একটা বেশ তালগোল পাকানো অবস্থা। অনেকে হার্ড ইমিউনিটির কথা ভাবছেন, যার ধারণা আসলে হতাশাব্যাঞ্জক।

১৯১৮-১৯২০ সালে ঘটে যাওয়া ইনফ্লুয়েনজা মহামারির শিক্ষা হলো, আদতে হার্ড ইমিউনিটি বলে কিছু নেই। মহামারির শেষ দিকে ভাইরাসটি দুর্বল হয়ে পড়ে নানা মিউটেশনের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে ক্রমে এটাই মহামারির সমাপ্তি ঘটায়, এমন নয় যে মানুষের দেহে কার্যকর কোনো অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে তাকে থামিয়ে দেয়। তাহলে এখনো আমাদের আশা আছে যে হয়তো দ্রুতই মহামারির সমাপ্তি ঘটবে আর আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাব?

যাঁরা এই স্বাভাবিক জীবনের কথা ভাবছেন, তাঁদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে পৃথিবী এই মহামারির আগেও খুব একটা স্বাভাবিক ছিল না। ছয় মাস আগেও আমরা এক ভয়ংকর অকার্যকর বিশ্বে বাস করতাম। মেডিসিন বা চিকিৎসাবিজ্ঞান যেখানে ছিল অযৌক্তিক, অকার্যকর, অসম্ভব রকমের চড়া দামের, নাগালের বাইরের এবং ভীষণভাবে আত্মকেন্দ্রিক। এই মেডিকেল দুনিয়ায় করপোরেট আর প্রশাসনের ভার ছিল অকল্পনীয়, স্বাস্থ্যকর্মীরা হয়ে উঠছিলেন হতাশ আর মেডিকেল ব্লগগুলোতে ভরা থাকত কেবল মানসিক যন্ত্রণার কথা। এই মুহূর্তে আমরা যারা স্বাভাবিকে ফিরে যেতে আকুল, তারা ভুলে যাচ্ছি যে আগেও আমরা সুখী ছিলাম না মোটেও। কিন্তু আসলেই কি আমরা ফিরে যাচ্ছি? মনে হয় না। কোভিড-১৯ পরবর্তী চিকিৎসাবিজ্ঞানে আসবে এক অচিন্তনীয় পরিবর্তন, যার আভাস দেখা যাচ্ছে এখনই। দেখা যাক তা কেমন হতে পারে।

১. কোভিড-১৯ নাটকীয়ভাবে আমাদের বোধোদয় ঘটাল যে স্বাস্থ্যসেবা আসলে প্রত্যেক মানুষের অধিকার। আমি কর দিই কি না, আমার ইনস্যুরেন্স আছে কি না, আমি যে–ই হই না কেন, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার আমার আছে। কারণ, আমি সুস্থ না থাকলে কেউই ভালো থাকছে না। এই অধিকারসচেতনতা স্বাস্থ্যসেবায় আনবে এক বিরাট পরিবর্তন। রাষ্ট্র আর সমাজ নিজেদের নতুনভাবে সাজাতে বাধ্য হবে একে ফোকাস করে। গুটি কতক ভাগ্যবান নয়, সবাই এর ভাগীদার হওয়ার আশা রাখবে।

২. কোভিড-১৯ চিকিৎসা আর বিজ্ঞানের দিকে মানুষের দৃষ্টি আর আস্থা ফেরানোর এক মহা সুযোগ হিসেবে দেখা দিল। মানুষ ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্যকর্মীদের সবচেয়ে বড় হিরো ভাবতে শুরু করেছে, বেঁচে থাকা আর সেরে ওঠাকে সেলিব্রেট করছে অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে। আর এর মধ্যে যদি কোনো টিকা আবিষ্কার হয়েই যায়, তাহলে মানুষ বুঝবে এগুলোই হলো আসলে মানবজাতির সেরা তুলনাহীন আবিষ্কার। মানুষের মনোজগতে এই পরিবর্তন এরই মধ্যে দেখা দিচ্ছে।

৩. চিকিৎসকের সঙ্গে রোগীর যোগাযোগের পদ্ধতিই পাল্টে দিচ্ছে কোভিড-১৯। আশা করা যায় টেলিমেডিসিন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হবে সামনের দিনগুলোয়। এই প্রযুক্তির দুনিয়ায় কেনইবা রোগীরা কষ্ট করে আর চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে যাবে। যদি বাড়িতে বসেই অনেক কাজ হয়ে যায়? এমনকি চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বা বিনিময়ের পদ্ধতিতেও আসবে পরিবর্তন। এরই মধ্যে এ বছরের সব বড় বড় কনফারেন্স আর সেমিনার গেছে বাতিল হয়ে। বেশির ভাগই পরিবর্তিত হয়েছে ভার্চ্যুয়াল কনফারেন্সে। কাউকে আর বিমানযাত্রা করে, হোটেলে চেক ইন করে ছুটে গিয়ে স্পিকারের বক্তব্য শুনতে হচ্ছে না। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এলেও কি আবার আগের মতো এগুলো হওয়ার সম্ভাবনা আছে? মনে হয় না। কারণ, অনেক কম খরচে আর কম আয়াসে জ্ঞানের বিনিময় সম্ভব। এটা আমরা শিখে গেছি।

৪. মেডিকেল জার্নালগুলো অবিশ্বাস্য দ্রুততায় গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করে চলেছে, তা–ও অনলাইন ভার্সনে আর যথাসম্ভব উন্মুক্ত করে। কয়েক মাস আগেও এমনটা সম্ভব ছিল কি? মেডিকেল প্র্যাকটিশনাররাও কি এসব প্রবন্ধ পড়তে এতটা উৎসাহী ছিলেন আগে? তথ্য এখন অবাধে বৈজ্ঞানিক জার্নাল থেকে টুইটার ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ছে, যাচ্ছে পত্রিকায়, রাজনিতীকদের বক্তব্যে, এমনকি পিয়ার রিভিউ হওয়ার আগেই; গুণমান বিচারের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার তোয়াক্কা না করেই। আর তার পাঠক হচ্ছেন কেবল চিকিৎসক বা বিজ্ঞানীরা নন, আপামর জনসাধারণও। লাখ লাখ বার শেয়ার হচ্ছে বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রবন্ধ। কিছুদিন আগেও কি তা বিশ্বাস হতো?

স্বাভাবিকে ফিরে যাওয়ার কথায় আমরা ওয়ারেন হার্ডিংয়ের কথা একটু স্মরণ করতে পারি। ১৯১৪ থেকে ১৯১৯ পর্যন্ত কয়েক বছরব্যাপী মহামারি যখন আমাদের বিপর্যস্ত করে তুলেছিল, তখন ১৯২০ সালে হার্ডির প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনের স্লোগান ছিল 'রির্টান টু নরমালসি' বা স্বাভাবিকের দিকে ফেরা। লোকে তাঁর এই আশার বাক্য লুফে নিয়েছিল আর হার্ডিং জিতেছিলেন ৬০ শতাংশ ভোটে। হার্ডিং তারপর দেশের অন্যতম ধনকুবের এন্ড্রু মেলোনকে সেক্রেটারি অব ট্রেজারি নিযুক্ত করলেন। মেলোনের মূল আইডিয়া ছিল একটি ব্যবসায়ী বান্ধব অর্থনৈতিক অ্যাজেন্ডা গড়ে তোলা যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ দ্রুতই এক ভোগবাদী আর আত্মম্ভরিতার সংস্কৃতিতে প্রবেশ করে। মার্কিন সরকার এক বিষময় অর্থনৈতিক বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থাকে সমর্থন দিতে থাকে, নিষ্ঠুর অ্যান্টি–ইমিগ্রেশন পলিসি গ্রহণ করে আর বিজ্ঞানের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করে। ১৯২৯ সালে স্টক মার্কেটে ধস নামে। ফলে আমেরিকানরা এক গ্রেট ডিপ্রেশনের মুখোমুখি হয়। এই ছিল স্বাভাবিকে ফিরে যাওয়ার পরিণতি।

আমরা ফিরে যেতে চাই না আর। আমরা এক নতুন পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চাই। এই ক্রাইসিস আমাদের কোভিড–পূর্ববর্তী ভুলগুলো শোধরানোর সুযোগ এনে দিয়েছে। কোনটা ঠিক আর কোনটা অন্যায়, তা বেছে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তাই আবার কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাব, সে চিন্তা বাদ দেওয়াই ভালো। সময়ই বলে দেবে স্বাভাবিকতার রূপ কী।

লেখক: কার্ডিওলজিস্ট ও গবেষক, বেইলোর ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টার, ডালাস, টেক্সাস।

মেডপেজ টুডে অবলম্বনে অনুবাদ: তানজিনা হোসেন