Thank you for trying Sticky AMP!!

করোনা এবং আমার কয়েকটি দিন

হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে গেল। অনুভব করলাম, শরীরটা গরম গরম লাগছে। বিছানার পাশে টেবিলে রাখা ডিজিটাল ঘড়ির দিকে তাকালাম। সময় রাত ২টা ৪৭ মিনিট।

পাশেই স্ত্রী সুমি ঘুমাচ্ছে। এত রাতে ডাকা ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারছি না। সকালে তার অফিস আছে। (সে নিউইয়র্ক সিটির পুলিশ অফিসার হিসেবে কর্মরত)। অবশ্য না ডেকেও উপায় নেই। এ মুহূর্তে তার সাহায্য আমার দরকার। আস্তে করে তার বাহুতে মৃদু চাপ দিলাম। তারপর কোমল স্বরে ডাকলাম, সুমি একটু উঠবি? (স্ত্রী আমার সহপাঠী ছিল। ক্যাম্পাসে আমরা একে অপরকে তুই করে সম্বোধন করতাম। অভ্যাস বিয়ের পরও রয়ে গেছে।)

তার ঘুম খুবই পাতলা। এক ডাকেই সাড়া দিল। তবে কী বুঝল জানি না। সে যেভাবে শুয়ে ছিল, ঠিক সেভাবেই শুয়ে রইল এবং চোখ না খুলেই ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল, শোন বিরক্ত করিস না। সকালে আমার অফিস আছে। চুপচাপ ঘুমা। বুঝলাম উল্টো বুঝেছে। ঠিক করলাম আর ডাকব না। আমি তাকে আর না ডেকে জড়িয়ে ধরলাম। মনে হলো তার শরীরে বিদ্যুতের ঝটকা লেগেছে। সে দ্রুত উঠে বসল। আমার কপালে-গালে হাত দিয়ে বলল,
এই তোর গা তো পুড়ে যাচ্ছে।


সেই কারণেই তো তোকে ডাকলাম। কিন্তু তুই তো উল্টো বুঝলি।


সুমি দ্রুত থার্মোমিটার বের করল। জ্বর ১০৩। বাসায় জরুরি প্রয়োজনের সব ধরনের ওষুধের একটা ছোট স্টক রয়েছে। সেখান থেকে একটি Tylenol 500mg খেয়ে নিলাম। সুমি বালতি ভরে পানি নিয়ে এল। প্রায় ঘণ্টাখানেক মাথায় পানি ঢালল। এরপর আবার জ্বর মাপল। ফলাফল একই জ্বর ১০৩ ডিগ্রি। বুঝলাম না হঠাৎ করে কী হলো। আমি তো ভালেই ছিলাম। গতকাল অফিসও করেছি। (ফাস্ট রেসপন্ডার হিসেবে এই লকডাউনের মধ্যেও অফিস করতে হচ্ছে। আমি নিউইয়র্ক সিটিতে কারেকশন অফিসার হিসেবে কর্মরত আছি।) হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম পুরো শরীরে ব্যথা শুরু হয়েছে। মাথাও প্রচণ্ড ব্যথা করছে। সারারাত সুমি মাথায় পানি ঢালল। কিন্তু জ্বর ১০১–এর নিচে আর নামল না।


সকালবেলা আমার ডাক্তারকে ফোন দিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে সাহায্য করার অবস্থায় নেই। কারণ, তিনি নিজেই করোনায় আক্রান্ত। বললেন, লেবু আদা দিয়ে গরম পানি খেতে আর গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করতে। কী আর করা, নিজেই ডাক্তার হয়ে গেলাম। রাতে খাওয়া ওষুধটাই দুটো করে তিন বেলা খেতে লাগলাম। যদিও একটি করে খাওয়ার নিয়ম। কিন্তু দ্রুত ভালো হওয়ার জন্য আমি দুটো করে খেতে লাগলাম। এভাবে কেটে গেল পাঁচ দিন। এই পাঁচ দিনে জ্বর একবারও ১০০–এর নিচে নামেনি। উল্টো জ্বরের সঙ্গে শুরু হলো ভয়ানক শরীর ব্যথা ও মাথাব্যথা।

সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিল ষষ্ঠ দিনে এসে। এদিন শরীর ব্যথা আর মাথাব্যথা সহ্যের বাইরে চলে গেল। সেই সঙ্গে শুরু হলো প্রচণ্ড কাশি। মুখ খুললেই কাশি শুরু হয়। যার কারণে কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল। কাশির জন্য এবার একটি করে ওষুধ তিন বেলা খাওয়া শুরু করলাম। দেখলাম এখন আর বুক ভরে লম্বা শ্বাস নিতে পারছি না। বাধ্য হয়ে ছোট ছোট শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে লাগলাম। খেয়াল করলাম আমার ঘ্রাণশক্তি হারিয়েছি। সেই সঙ্গে জিব হারিয়েছে স্বাদ বোঝার ক্ষমতা। শরীর এত দুর্বল হয়ে গেল যে বসেও থাকতে পারি না। এসব শারীরিক সমস্যা দেখে আমি মোটামুটি নিশ্চিত হলাম যে করোনায় আক্রান্ত। সেই সঙ্গে কেন জানি মনে হলো আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে। সুমিকে এসবের কিছুই বললাম না। তবে আমার শারীরিক অবস্থা দেখে সুমি যে ভয় পেয়েছে, তা বুঝতে পারলাম।


সপ্তম দিন সকালে আমার অবস্থার আরও অবনতি হলো। এদিন সুমির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলল, তোর উদ্দেশ্য কী? তুই কি আমাকে বিধবা বানানোর ধান্দায় আছিস?
মানে কী?
বলেই কাশতে লাগলাম।
মানে কি তুই বুঝিছ না? তোকে আমি প্রতিদিনই বলছি, চল হাসপাতালে যাই। তুই আমার কথা শুনছিস না। এভাবে চললে তো তুই মারা যাবি।
শোন, হাসপাতালে এখন আর কোনো জায়গা নেই। আর তা ছাড়া আমার তো এখনো শ্বাসকষ্ট শুরু হয়নি। আমি কেন হাসপাতালে যাব?
কাশতে কাশতে কথাগুলো বললাম।
খবরদার, বেশি পাকনামো করবি না।
না, আমি কোনো পাকনামো করছি না। শোন, ভয় পাস না। আমি এত সহজে মরছি না।
কাশতে কাশতে কথাগুলো বললাম।
খবরদার, একটা কথাও বলবি না।
মানে কী! তুই কি আমাকে কথাও বলতে দিবি না! অসুস্থ স্বামীর সঙ্গে কেউ এমন ব্যবহার করে?
বদমাশ ব্যাটা তোর তো মুখ খুললেই কাশি আসে। আমি সে জন্য কথা বলতে নিষেধ করেছি। এখন বল, তুই ডাক্তারের কাছে যাবি কি না।
আরে আমি তো ওষুধ খাচ্ছি। ডাক্তারের কাছে গিয়ে লাভ কী। ডাক্তার তো একই ওষুধ দেবে।
আবার কাশতে লাগলাম।


ওই তোরে না বলছি কথা বলবি না।
আমার কী দোষ। তুই তো প্রশ্ন করলি।
এখন থেকে আমি প্রশ্ন করলেও তুই কথা বলবি না। শুধু মাথা নেড়ে উত্তর দিবি। ঠিক আছে?
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম।
হাসপাতালে যাবি না, ঠিক আছে। কিন্তু আমি গত ছয় দিন থেকে তোকে বলছি চল আর্জেন্ট কেয়ারে যাই। সেখানেও তুই যাচ্ছিস না। আমি তো এর কোনো মানে বুঝতেছি না।
সুমির কথা বলার পুরোটা সময় আমি অনবরত মাথা নাড়ালাম। সুমি আমার মাথা নাড়ানো দেখে অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার, তুই সারাক্ষণ মাথা নাড়াচ্ছিস কেন?
তুই তো আমাকে মাথা নাড়াতে বললি।


ওই ব্যাটা, আমি কি তোরে আজাইরা মাথা নাড়াতে বলেছি? খবরদার, সারাক্ষণ মাথা নাড়াবি না। আরেকবার যদি তুই বিনা কারণে মাথা নাড়াইছস, তো হাতুড়ি দিয়া তোর মাথায় একটা বাড়ি দেব। কথাটা মনে রাখিস।
আমি ভয়ে ভয়ে আস্তে করে একবার মাথা নেড়ে তাকে বোঝালাম যে আমি তার কথা বুঝেছি।
ড্রাইভ করার মতো কোনো শক্তি আমার শরীরে নেই। তাই বাধ্য হয়ে উবার কল করলাম। বাসার আশপাশে বেশ কয়েকটি আর্জেন্ট কেয়ার আছে। তবে আমরা নিচের ঠিকানায় গেলাম।
CITYMD
Urgent care
37-26 Junction Blvd, Corona, NY 11368


আর্জেন্ট কেয়ারের সামনে যাওয়ার পর বউ গাড়ি থেকে নেমেই চাপা গলায় রাগত স্বরে বলল, আমি বুঝলাম না, তুই এই আর্জেন্ট কেয়ারে আসলি কেন?
কেন, এখানে সমস্যা কী?


দুনিয়ার এত জায়গা থাকতে চিকিৎসার জন্য তোকে করোনা নামক এলাকায় আসতে হবে? এটা কোন ধরনের ফাজলামি? আমি জানি, তুই এটা ইচ্ছে করে করেছিস।
বিশ্বাস কর, আমি এভাবে চিন্তা করিনি। আর তা ছাড়া করোনা নামক এলাকায় এসেছি বলে যে আমাদেরও করোনা হবে, এর তো কোনো মানে নেই। শোন, ভেজাল করিস না। এসে যখন পড়েছি, তো এখানেই ডাক্তার দেখিয়ে ফেলি।
কাশতে কাশতে কথাগুলো বললাম।

ছবিটি প্রতীকী। ছবি: রয়টার্স

নিউইয়র্কে করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। সব হাসপাতাল আর আর্জেন্ট কেয়ারে এখন লম্বা লাইন। এখানেও আর্জেন্ট কেয়ারের বাইরে লম্বা লাইন। সবাই ছয় ফুট দূরে দূরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। আমিও দাঁড়ালাম। সুমি আমার থেকে ছয় ফুট পেছনে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বুঝলাম, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। মনে হলো মাথাটা একটু একটু ঘুরছে। বাধ্য হয়ে লাইনের মধ্যেই বসে পড়লাম। ফুটপাতে পড়ে যাওয়ার আগেই সুমি এসে ধরে ফেলল। তারপর ধরে ভেতরে নিয়ে ওয়েটিং রুমের সোফায় বসিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর সব ফরমালিটি শেষ করে ডাক্তারের রুমে ঢুকলাম। ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা করলেন। এরপর বুকের এক্স–রে করাতে বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন ডাক্তার।


আমি এখন ডাক্তারের রুমে একা বসে আছি। কিছুক্ষণ আগে এক্স–রে করে এসেছি। এক্স–রে রিপোর্ট রেডি হলে ডাক্তার আবার আসবেন। একটু পর একজন নার্স এসে রুমে ঢুকলেন। কারণ, ডাক্তার নাকি রক্ত পরীক্ষা করতে বলেছেন। নার্স রক্ত নেওয়া শেষ করতেই হঠাৎ করে খেয়াল করলাম আমি আর শ্বাস নিতে পারছি না। চারদিক কেমন জানি অন্ধকার হয়ে আসছে। মনে হলো আমার ভেতর থেকে কে যেন আমাকে বলছে কালেমা পড়। মনে মনে কালেমা পড়া শুরু করলাম। লা ইলাহা...পর্যন্ত পড়েই কালেমা পড়া বন্ধ করে দিলাম। কেন জানি মনে হলো, আমি এখন কালেমা পড়া শেষ করলেই আল্লাহ আমাকে এই দুনিয়া থেকে নিয়ে যাবেন। অথচ আমি এখন মরতে চাইছি না। কারণ, স্ত্রী ও ছোট্ট দুই মেয়েকে বিদেশের মাটিতে এভাবে অসহায় অবস্থায় রেখে মারা যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।


খেয়াল করলাম, নার্স রক্তভর্তি টিউবগুলো নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। যেভাবেই হোক নার্সকে থামাতে হবে। কারণ, আমার সাহায্য দরকার। আমার অক্সিজেন দরকার। অনেক কষ্টে নার্সকে বললাম, ‘প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন। আমি শ্বাস নিতে পারছি না।’


নার্স ঘাড় ঘুরিয়ে একবার আমাকে দেখেই দৌড় দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। বুঝলাম না উনি আমাকে সাহায্য না করে এভাবে কেন চলে গেলেন।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ডাক্তার তিনজন নার্সকে নিয়ে রুমে ঢুকলেন। সঙ্গে অক্সিজেন সিলিন্ডার। একজন নার্স এসে আমি যে চেয়ারে বসে ছিলাম সে চেয়ারের একটা বাটন চাপ দিলেন। চেয়ারটি বেডে পরিণত হয়ে গেল। আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম, প্লিজ ডাক্তার আমাকে সাহায্য করুন। আমি মারা যাচ্ছি।
ডাক্তার বললেন, ভয় পেয়ো না। তোমার কিছু হবে না।


দ্রুত আমাকে অক্সিজেন দেওয়া হলো। আমার ধারণা ছিল, বিদেশি মানুষগুলোর মধ্যে অন্যের জন্য আবেগ কম থাকে। কিন্তু আমার এ ধারণা ভুল। কারণ, খেয়াল করলাম, আমার এই অবস্থা দেখে একজন নার্সের চোখে পানি টলমল করছে। সম্ভবত মেয়েটি এ পেশায় নতুন, যার কারণে মনটা এখনো শক্ত হয়নি। আর কিছু ভাবতে পারলাম না। হঠাৎ করেই চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। আমি জ্ঞান হারালাম।
অনেকক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে দেখলাম রুমে আর কেউ নেই। আমি একা রুমের মধ্যে শুয়ে আছি। অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে বুক ভরে অক্সিজেন নিতে নিতে আল্লাহকে বললাম, আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি জানতাম তুমি আমার মেয়ে দুটোকে এতিম করবে না।


একটু পর ডাক্তার একজন নার্সসহ রুমে ঢুকলেন। তাঁদের রুমে ঢুকতে দেখেই দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ডাক্তার কাছে এসে আমাকে ডাকলেন। আমি ধীরে ধীরে চোখ খুললাম। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, এখন কেমন আছেন?
ভালো।
আচ্ছা বলুন তো, আপনি এখন কোথায় আছেন?


বুঝলাম আমার চেতনা শক্তি মানে জ্ঞান-বুদ্ধি ঠিক আছে কি না ডাক্তার তা পরীক্ষা করছেন। সিদ্ধান্ত নিলাম ডাক্তারের সঙ্গে একটু মজা করব। ডাক্তার আবার বললেন, আপনি কি বলতে পারবেন, আপনি এখন কোথায় আছেন?
অবশ্যই পারব। আমি এখন হোয়াইট হাউসে আছি।
কী বললেন!
বললাম হোয়াইট হাউসে আছি।
আমার কথা শুনে ডাক্তারের ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি কী বলবেন তা বুঝতে পারলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি আবার প্রশ্ন করলেন,
আপনি কি শিওর যে আপনি এখন হোয়াইট হাউসে আছেন?
জি, আমি এক শ ভাগ শিওর।
আচ্ছা বলুন, তো আপনার নাম কী?
ডোনাল্ড ট্রাম্প।


ডাক্তারের ভুরু দুটো এবার আরও বেশি কুঁচকে গেল। তিনি আমার দিকে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। একটু পর তিনি ফিসফিস করে নার্সকে কিছু একটা বললেন। নার্স দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই নার্স আমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে রুমে ঢুকলেন। সুমি ভেতরে ঢুকেই আমার মুখে অক্সিজেন মাস্ক দেখে ঘাবড়ে গেল। ডাক্তার সুমিকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ভয়ের কিছু নেই, উনি ভালো আছেন।
ডাক্তার এবার সুমিকে দেখিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি ওনাকে চিনতে পারছেন?
জি, চিনতে পারছি।
আপনি কি বলতে পারবেন উনি কে?
অবশ্যই পারব।
ডাক্তারের চোখে-মুখে একটা খুশির ভাব ফুটে উঠল। উনি উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ভেরি গুড। বলুন তো উনি কে?
উনি অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।


এবার ডাক্তার, নার্স এবং সুমি একসঙ্গে ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। ডাক্তার ও নার্সের দৃষ্টিতে অবাক হওয়ার ভাব থাকলেও আমার স্ত্রীর তাকানোতে ছিল আগুনের আভাস। বুঝলাম সে প্রচণ্ড রেগে গেছে। আমি বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে তিনজনের দিকে তাকিয়ে কার ভুরু বেশি কুঁচকে আছে, তা মাপার চেষ্টা করলাম। মাপার কাজ শেষ হওয়ার আগেই সুমি রেগে চাপা গলায় বাংলায় বলল, কী বললি, আমি কে? আমি আ্যঞ্জেলিনা জোলি? আর তুই কী? তুই কি ব্র্যাড পিট? ব্যাটা বদমাশ, এত অসুখের মধ্যেও তোর বাঁদরামি যায় না? সবকিছু নিয়ে তোর ফাজলামি করতে হবে!


রাগ করিস কেন? আরে ডাক্তারের সঙ্গে একটু মজা করলাম। দেখ কেমন ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকায়ে আছে। উল্টাপাল্টা কথা বলে মহিলার মাথা একেবারে আউলা কইরা দিছি।
কাশতে কাশতে কথাগুলো বললাম। ডাক্তার আর নার্সের মুখ মাস্কে ঢাকা থাকায় বুঝতে পারিনি তারা কোন দেশি। আমার কথা শেষ হওয়ামাত্রই নার্স মুখের মাস্কটি একটু নামিয়ে বললেন, ভাই, আমি কিন্তু বাঙালি।
এবার আমি আর সুমি অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে নার্সের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নার্স স্মিত হেসে ডাক্তারকে ইংরেজিতে বললেন, কোনো সমস্যা নেই। রোগী ঠিক আছে। সে আসলে তোমার সঙ্গে মজা করছে।

প্রতীকী ছবি

ডাক্তারও স্মিত হেসে বললেন, ভালো। এ সময় মজা করা ভালো। এতে মনোবল ঠিক থাকবে। এই রোগে মনোবল শক্ত রাখাটা জরুরি।

ডাক্তার আমার সব রিপোর্ট পরীক্ষা করে ঘোষণা করলেন, আমি করোনায় আক্রান্ত। এখন নিউমোনিয়া হয়ে গেছে। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন আমাকে প্রচুর পানি খেতে হবে। অবশ্যই গরম পানি। আর সেই সঙ্গে কিছু ওষুধ দিলেন। ওষুধগুলো খাওয়ার ছয় দিন পর জ্বরটা চলে গেল। তবে মাথাব্যথা আর কাশিটা গেল না।

সাত দিন পর ফলোআপের জন্য আর্জেন্ট কেয়ারে আবার গেলাম। এবারও বুকের এক্স–রে করালেন। এক্স–রে দেখে ডাক্তার বললেন, অবস্থা আগের থেকে ভালো। এবার ওষুধ দিলেন। কিন্তু কাশি এরপরও কমল না। সেই সঙ্গে মাথাব্যথাও রয়ে গেল। 

সাত দিন পর আবারও ফলোআপের জন্য গেলাম। সাধারণত এক মাসের মধ্যে দুবারের বেশি এক্স–রে ডাক্তাররা করতে চান না। কিন্তু আমার অবস্থা দেখে ডাক্তার আবারও এক্স–রে করলেন। এক্স–রে রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বললেন, আগের থেকে রিপোর্ট একটু ভালো। তবে নিউমোনিয়ার ছাপ বুকে এখনো রয়ে গেছে। তাই এবার ডাক্তার দুই ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিলেন। কাশির জন্য ওষুধ দিলেন। বর্তমানে আমি এখন এই ওষুধগুলোই সেবন করছি। পুরোপুরি সুস্থ না হলেও আমি এখন আগের থেকে অনেক ভালো আছি। সম্ভবত মনে হচ্ছে আল্লাহর রহমতে আমি করোনাকে জয় করতে পেরেছি।

বি. দ্রষ্টব্য
ওষুধগুলোর নাম দিলাম না। সব থেকে দরকারি এবং কার্যকরী ওষুধের নামটি হলো মনোবল। এটি অবশ্যই থাকতে হবে। এটি থাকলে করোনা আপনার সঙ্গে কোনোভাবেই পারবে না। তাই বলছি আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন। আর মনোবলটা শক্ত করুন। সত্যি বলতে কি, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর আমার নিজের মনোবল একেবারে ভেঙে গিয়েছিল। বারবার মনে হচ্ছিল আমি হয়তো মারা যাব। কিন্তু সুমি তার সেবা দিয়ে, সাহস দিয়ে আমার সে হারিয়ে যাওয়া মনোবল ফিরিয়ে এনেছে।

imdadbabu@yahoo.com