Thank you for trying Sticky AMP!!

কৃষক ও খামারিদের এখনই প্রণোদনা দরকার

বোরো ধান কাটার মধ্য দিয়ে হাওরাঞ্চলে বৈশাখ শুরু হয়। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে শ্রমিকসংকটে কৃষকেরা। প্রথম আলো ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ ও দেশব্যাপী অঘোষিত লকডাউনের কারণে সারা দেশে ব্যাপক হারে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একদিকে যেমন যাঁরা হঠাৎ করে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, তাঁদের জন্য অবিলম্বে খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। তেমনিভাবে ভবিষ্যতের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য কৃষক ও খামারিদেরও বাঁচাতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে আমরা মনে করি যে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ অপ্রতুল ও অসম্পূর্ণ।

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাব খুব বড়ভাবে পড়েছে পোশাকশিল্পসহ আমাদের রপ্তানি খাতের ওপরে। বিশেষভাবে এর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে জনশক্তি রপ্তানি এবং এ খাত থেকে প্রাপ্ত আয় ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে। জাতীয় স্বার্থে এ খাতগুলোকে বাঁচাতে হবে। তবে এসব খাতের ভবিষ্যৎ বহুলাংশে নির্ভর করবে অন্যান্য রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত, বিশ্ব অর্থনীতির গতি–প্রকৃতি এবং উৎপাদনব্যবস্থার যান্ত্রিকীকরণের প্রভাবের ওপর।

এমন পরিস্থিতিতে আমাদের কৃষি, কৃষক ও খামারিদের বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। কৃষক ও খামারিরা বেঁচে না থাকলে চলমান খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। সরকার বলছে, গুদামে পর্যাপ্ত চাল মজুত আছে, কিন্তু শুধু চালের সরবরাহ নিশ্চিত করলেই খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা দূর হবে না। এর জন্য আরও প্রয়োজন হবে মাছ-মাংসসহ অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারের, যার জোগান আসবে খামারিদের থেকে।

এর চেয়েও ভয়ের কথা, কৃষি খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটলে ভবিষ্যতে আমরা আরও জটিল সংকটে নিপতিত হতে পারি। তবে তঁাদের ভবিষ্যৎ উৎপাদন ক্ষমতানির্ভর করবে বর্তমানে তঁারা কী ধরনের সুরক্ষা পাচ্ছেন তার ওপর। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমরা বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করে আমাদের প্রয়োজন পুরোপুরি মেটাতে পারব কি না, তা নিয়ে সন্দিহান হওয়ার অবকাশ রয়েছে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ২০০৮ সালে অপেক্ষাকৃত শান্ত বিশ্ব পরিস্থিতিতে, আমাদের তৎকালীন সরকারের পক্ষে প্রয়োজনীয় চাল আমদানি করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিল। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অপর্যাপ্ত হলে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে দামের ওপর। মনে আছে, কিছুদিন আগে পেঁয়াজের দামে উল্লম্ফনের কথা!

দেশের অনেক অঞ্চলে এখন ইরি ধান কাটার সময়। হাওরে বোরো ধান কাটারও এখন সময়। এ সময়ে উত্তরবঙ্গ থেকে কৃষিশ্রমিকেরা বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে ধান কাটেন। কিন্তু লকডাউন এবং পরিবহনব্যবস্থা অচল হওয়ার কারণে এসব শ্রমিক যদি ধান কাটতে যেতে না পারেন, তাহলে ধানের উৎপাদন হ্রাস পাবে। সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপের কারণে যদি বিশেষ ব্যবস্থায় পরিবহনের ব্যবস্থা করাও যায়, ধান কাটার পর সমস্যা দেখা দেবে উপযুক্ত মূল্যে এগুলো বিক্রির, যাতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত না হন। এ জন্য প্রয়োজন হবে সরকারের পক্ষ থেকে অধিক পরিমাণে ধান ন্যায্যমূল্যে ক্রয়ের। সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী সরকারের পক্ষ থেকে ১৭ লাখ টন চাল সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ক্রয়ের ঘোষণা দিয়েছেন। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দলীয় পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কথা আমাদের জানা। বর্তমানে ত্রাণের চাল নিয়ে চালবাজির সমস্যাই সরকার সামাল দিতে পারছে না। এ ছাড়া অতিরিক্ত চাল সংগ্রহ করলে তা রাখার প্রয়োজনীয় গুদামও প্রস্তুত থাকতে হবে।

করোনাভাইরাসের আগ্রাসনে খামারি পর্যায়ে মুরগি, ডিম ও দুধের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। দাবি করা হচ্ছে যে প্রতিদিন খামারিরা এক লাখের মতো মুরগির বাচ্চা মাটিতে পুঁতে ফেলছেন। বিক্রি করতে না পেরে অনেকে দুধ ফেলে দিচ্ছেন। পোলট্রি খাতে গত এক মাসে দুই হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে (প্রথম আলো, ১২ এপ্রিল ২০২০)। এ ছাড়া বর্তমানে লকডাউনের কারণে মৎস্য খামারিরা মাছের পোনা সংগ্রহ ও অবমুক্ত করতে পারছেন না, যা আগামী মৌসুমে মাছের উৎপাদনকে বিঘ্নিত করবে।

গত কয়েক দশকে আমাদের দেশে পোলট্রি ও গরু-ছাগল উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আমাদের আমিষের চাহিদা অনেকটা পূরণ করছে। পোলট্রি খাতে বর্তমানে ৬৫ হাজার খামারি রয়েছেন এবং তাঁরা ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ করেছেন। আমাদের সারা দেশে ৭০ হাজারের মতো গরু-ছাগলের খামার রয়েছে। এসব উৎপাদনকারীর অধিকাংশই তরুণ, যঁারা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রণোদনায় এবং অনেক ক্ষেত্রে সরকারি প্রশিক্ষণ ও ঋণ সুবিধা নিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে তাঁরা খামার প্রতিষ্ঠা করেছেন। এখন তঁাদের অনেকের সর্বস্বান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তার ওপর।

এমনি প্রেক্ষাপটে ঘোষিত হয়েছে কৃষি খাতকে সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষে্য প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা প্যাকেজ, যাতে ক্ষতিগ্রস্তদের ৫ শতাংশ সুদে ৫ হাজার কোটি টাকা প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো এ ঋণ দেবে এবং জুলাই মাস থেকে তা শুরু হবে। ঘোষিত প্যাকেজ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরবর্তী সময়ে সুদের হার ৪ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।

প্রস্তাবিত প্যাকেজের আওতায় ঋণ নিতে পারবেন গ্রামাঞ্চলের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক; যঁারা পোলট্রি, কৃষি ফার্ম, ফলমূল, মসলাজাতীয় খাদ্যপণ্য উৎপাদন করবেন। দেশের শিল্প ও রপ্তানি খাতের জন্য ইতিমধ্যে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রণোদনার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দেওয়া ঋণ যেমন আছে, তেমনি সরকারি ভর্তুকি দেওয়া ৪ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ হারে দেওয়া ঋণও আছে। তাই মাঝারি ও ক্ষুদ্র কৃষকদের ৪ শতাংশ সুদে দেওয়া ঋণ কোনোভাবেই উপযোগী হতে পারে না। বরং মাঝারি কৃষকদের জন্য ২ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।

শুধু তাই নয়, একেবারে প্রান্তিক কৃষক ও খামারিদের জন্য অফেরতযোগ্য অনুদান দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া ঋণ প্রদান জুলাই থেকে শুরু করা নিশ্চিতভাবেই দেরি হয়ে যাবে। তাই এ মুহূর্তেই কৃষক ও খামারিদের প্রণোদনা দেওয়া জরুরি।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর