Thank you for trying Sticky AMP!!

টিকার ঘাটতি, পরিকল্পনায় ব্যাঘাত

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কেনা টিকার পরবর্তী চালান কবে আসবে, তা কেউ জানে না।

শ্বাসকষ্ট প্রচণ্ড বেড়ে যাওয়ায় আজিজুল হককে স্বজনেরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর আইসিইউ শয্যা না পেয়ে আলাদা অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করে সাধারণ শয্যায় ভর্তি করানো হয় তাঁকে। গতকাল দুপুরে হাসপাতালের সামনে

প্রথম ডোজ নেওয়া সবাইকে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার মতো করোনার টিকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই। টিকার পরবর্তী চালান কবে আসবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। এই পরিস্থিতিতে জাতীয় টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনা ঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

দেশে এখন একই সঙ্গে করোনা টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া চলছে। গতকাল রোববার ২ লাখ ৩৩ হাজার ৭৭৩ জনকে টিকা দিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। এর মধ্যে প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে ১২ হাজার ১৫৭ জনকে। দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ২১ হাজার ৬১৬ জনকে।

এদিকে টিকার মজুত দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে। গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে টিকার মজুত ছিল ৩৪ লাখ ৪৯ হাজার ১৯১ ডোজ।

বর্তমান টিকাদান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ও টিকাবিষয়ক কমিটির প্রধান মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ী টিকা দেওয়া যাচ্ছে না। বয়সসীমা কমিয়ে আরও ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা ছিল। টিকার স্বল্পতার কারণে তা হচ্ছে না।’ তবে তিনি বলেন, ভারত থেকে টিকা আনার ব্যাপারে উচ্চপর্যায়ে আলোচনা চলছে।

পরিকল্পনামতো হচ্ছে না

সারা দেশে করোনা টিকা দেওয়ার নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করছে জাতীয় কোভিড-১৯ টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণ করে এই পরিকল্পনা তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পরিকল্পনায় করোনা মোকাবিলায় সম্মুখসারির কর্মীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার কথা বলা আছে। এর পাশাপাশি সরকার ঘোষণা দেয়, ৪০ বছর বা তার বেশি বয়সী যেকোনো নাগরিক টিকার জন্য নিবন্ধন করতে পারবেন। ধীরে ধীরে বয়সসীমা আরও কমিয়ে আনা হবে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ের প্রথম ধাপে ৩ শতাংশ এবং প্রথম পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপে ৭ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার কথা। অর্থাৎ প্রথম পর্যায়ে ১ কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রথম পর্যায়ের প্রথম ধাপে ৩ শতাংশকে, অর্থাৎ ৫১ লাখ ৮৪ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়া শেষ করেছে গত সপ্তাহে। এরপর দ্বিতীয় ধাপের টিকা দেওয়া শুরু হয়।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনা মহামারি মোকাবিলার স্থায়ী কার্যকরী পন্থা হচ্ছে গণটিকাদান কর্মসূচি। দেশে গণটিকাদান শুরু হয় ৭ ফেব্রুয়ারি। তখন টিকা দেওয়া নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ছিল। টিকা পাওয়া নিয়ে নানা অনিশ্চয়তার কারণে মানুষের মধ্যে সেই আগ্রহে ভাটা পড়েছে। মানুষ এখন টিকার জন্য নিবন্ধন কম করছেন। সর্বশেষ এক দিনে নিবন্ধন করেছিলেন মাত্র ১ হাজার ৬৩৮ জন। কিন্তু শুরুর দিকে কোনো কোনো দিনে ৫০ হাজার মানুষও নিবন্ধন করেছেন।

চুক্তি ও প্রাপ্তি

বাংলাদেশে অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত করোনার টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘কোভিশিল্ড’ নামের এই টিকা তৈরি করছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। সেরামের সঙ্গে তিন কোটি টিকা কেনার ত্রিপক্ষীয় চুক্তি আছে সরকারের। অন্য পক্ষটি বেক্সিমকো ফার্মা। চুক্তি অনুযায়ী বেক্সিমকো ফার্মা প্রতি মাসে ৫০ লাখ টিকা সেরাম থেকে এনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সরবরাহ করবে।

বেক্সিমকো প্রথম চালানের ৫০ লাখ টিকা এনেছিল জানুয়ারি মাসে। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসে এনেছিল ২০ লাখ টিকা। ফেব্রুয়ারির ৩০ লাখ ও মার্চের পুরো ৫০ লাখের চালান বাকি আছে। সে চালান কবে আসবে, তা কেউ জানে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, বেক্সিমকোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে টিকা আসবে। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে বলা হচ্ছে না কবে টিকা আসবে।

তবে আরও কিছু টিকা বাংলাদেশ পেয়েছে। জানুয়ারি মাসে ভারত তার প্রতিবেশী কয়েকটি দেশকে টিকা উপহার দিয়েছিল। তখন বাংলাদেশ ২০ লাখ টিকা উপহার পেয়েছিল। এরপর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তখন ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে ১২ লাখ টিকা দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান বাংলাদেশের সেনাপ্রধানকে এক লাখ টিকা উপহার দিয়েছেন।

সব মিলে বাংলাদেশের হাতে টিকা এসেছে এক কোটি তিন লাখ। এই টিকা দুই ডোজ করে ৫১ লাখ ৫০ হাজার মানুষকে দেওয়া সম্ভব।

কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইতিমধ্যে ৫৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪২ জনকে প্রথম ডোজ টিকা দিয়েছে। প্রতিদিন আরও নতুন মানুষকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়াও চলছে। গত এক সপ্তাহে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত সরকারের হাতে অবশিষ্ট টিকা ছিল ৩৪ লাখ ৪৯ হাজার ১৯১ ডোজ। বর্তমান ধারায় টিকা দেওয়া অব্যাহত থাকলে সপ্তাহ দুয়েক পর অবশিষ্ট টিকাও ফুরিয়ে যাবে। এর আগে নতুন টিকা না এলে প্রথম ডোজ পাওয়া কিছু মানুষ দ্বিতীয় ডোজ পাবেন না, এমন আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে।

বেক্সিমকো ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, টিকা পাঠাতে ভারত সরকারের একটি অনুমতি সেরামকে নিতে হবে বলে জানানো হচ্ছে। সোমবার বা তার পরের দিন সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাবে।

অনিশ্চিত অন্য উৎস

দেশের ওষুধবিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা শুরু থেকে বলে আসছেন, করোনার টিকার জন্য সরকারের একাধিক উৎসের অনুসন্ধান করা উচিত। একটি উৎসের ওপর নির্ভরশীলতা ঝুঁকির কারণ হতে পারে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত কয়েক মাসে একাধিক অনুষ্ঠানে ও সভায় সরকারের টিকা সংগ্রহের তৎপরতার কথা বারবার বলেছেন। তিনি বলেছেন, টিকা উৎপাদনকারী বিভিন্ন কোম্পানি ও দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। টিকা কেনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থও বরাদ্দ আছে।

অন্যদিকে করোনার টিকা সংগ্রহ ও বিতরণের বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্স থেকে টিকা পাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো সময় জানতে পারছেন না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, এ বছর কোনো একটা সময় কোভ্যাক্স থেকে টিকা পাওয়া যাবে। তবে জুন মাসের আগে সেটির আপাতত সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

করোনার টিকা দেওয়া চলছে, এমন প্রতিটি দেশে দ্বিতীয় ডোজ নিশ্চিত করে মানুষকে প্রথম ডোজ দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার নিশ্চয়ই প্রথম ডোজ টিকা নেওয়া প্রত্যেকের জন্য দ্বিতীয় ডোজ নিশ্চিত করবে। তা না হলে কিছু মানুষের প্রতি চরম অন্যায় করা হবে।’