Thank you for trying Sticky AMP!!

'ভাই, কথাগুলো কিন্তু বলার মতো না'

কুড়িগ্রাম-চিলমারী জেলা বোর্ডের সড়কটি সুনসান। মাঝেমধ্যে একটা-দুটো অটোরিকশা আসছে-যাচ্ছে। রাস্তার দুপাশে শত শত দোকান বন্ধ। দু-একটা খোলা, কিন্তু খদ্দের নেই। পোস্ট অফিস মোড় থেকে থানা মোড় পর্যন্ত ২০ থেকে ৩০ জন চর্মকার বেকার বসে আছে। জুতা সেলাই করাতে আসছে না কেউ। এরা আগে জুতা তৈরি করে বিক্রি করত। কিন্তু এ যুগে হাতে বানানো জুতা বিক্রি হয় না। এখন জুতা সেলাই করে দিন আনা দিন খাওয়া। এখন তাও নেই। উপরন্তু এরা জাতে ‘অচ্ছুত’। কার কাছে দুটো দানা পাবে?

সেলুনের কর্মচারীরাও এখন বেকার। চুল কাটতে গেলে তো সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকে না।

আগে গাঁয়ে মঙ্গার দিনে ‘ফ্যান দেও বাহে’ বলে ক্ষুধার্ত প্রতিবেশীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরত। এখন ছোঁয়াচে করোনার ভয়ে কে কাকে আহার দেয়! সামর্থ্যবানদের বাড়ির দরজায় তালা। তাদের রান্নাঘর পর্যন্ত ক্ষুধার্তের আহাজারি পৌঁছায় না। ১০ টাকা সের চাল বা বিধবা ভাতা কেউ কেউ পায়, বড় অংশই পায় না। সরকার জেলাপ্রতি ১০০ টন চাল ও উপজেলাপ্রতি ১ লাখ টাকা ত্রাণ বরাদ্দ করেছে। কুড়িগ্রাম জেলায় ইউনিয়ন আছে ৭৩টি। মানে ইউনিয়নপ্রতি ভাগে পড়ে মাত্র সোয়া টন। ৭১ ভাগ গরিবের ইউনিয়নে কতজন কতটুকু চাল পাবে? চিলমারীর জোড়গাছ মাঝিপাড়ার কোকিল মেম্বার (৫০) বললেন, চেয়ারম্যান তাঁর কাছে ১২ জনের নাম চেয়েছেন। কোকিল মেম্বারের প্রশ্ন, ‘কাক থুইয়ে কার নাম দেমো?’

ঐতিহ্যবাহী জোড়গাছ হাট। পাইকারি দোকানদার ফারুক মিয়া (৪২) জানান, করোনা আসার পর তাঁর বিক্রি বেড়েছে। কিন্তু ছোট দোকানদারদের অবস্থা যায় যায়। রমনা রেলস্টেশনের ছোট দোকানি বকুল সরকার গত তিন দিনে ১০০ টাকার মাল বিক্রি করতে পারেননি। জোড়গাছ হাট বন্ধ। হাটের একজন ফড়িয়া ইয়াসিন আলীর (৫২) পরিবারের সদস্য আটজন। প্রতি হাটে তাঁর আয় হতো প্রায় দেড় হাজার টাকা। তাঁর ছেলে লায়ন মিয়া (২১) মেধাবী ছাত্র। টিউশনি করে আয় করত কিছু টাকা। এখন বাপ-বেটা উভয়ে বেকার। আরেক ছেলে লিমন (১৮) দিনমজুর। তাঁদের ঘরে আছে ১০ মণ বাদাম। কিন্তু এখন কে কিনবে? লিমন বলল, ‘ভাই, কষ্টের কথা কিন্তু বলার মতো না।’

রমনার টোন গ্রামের বাসিন্দা মতিউর রহমান (৫২) বললেন, অভাবের তাড়নায় তাঁর পড়শিরা গরু-ছাগল বিক্রি করছে। কিন্তু কদিন আগে যে গরুর দাম ছিল ৬০ হাজার টাকা, তার দাম এখন ৪০ হাজার। হাঁস-মুরগিরও তো দাম ভীষণ কমে গেছে। অর্ধশত নদনদীময় কুড়িগ্রামে জেলে পরিবারের সংখ্যা হাজার দশেক। তারা নদনদী ও বিলগুলোয় মাছ ধরে বিক্রি করে চাল কেনে। এখন হাটবাজার বন্ধ বলে মাছের ক্রেতা কমে গেছে। ধানের দাম উঠেছে মণপ্রতি হাজার টাকায়। চালের বাজার চাতাল-মালিক আর আড়তদারদের দখলে। কৃষকদের বিক্রি করার মতো ধান নেই। চিলমারী নদীবন্দর-সংলগ্ন বাঁধের মোড়ে ছোট্ট বাজার। কৃষকেরা এখানে তাদের ফসল বেচে; দুধ বেচে গোয়ালারা। সবকিছুতেই মন্দা। বাঁধের রাস্তার বাড়িঘর উচ্ছেদ করা হয়েছে। কেউ কেউ অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। ঢাকা থেকে ফিরেছে অনেক মানুষ। কেউ রিকশা চালাত, কেউ পোশাক কারখানায় কাজ করত। এখন এই করোনার কালে তারা কী খেয়ে বাঁচবে? আর যারা বাড়ি ফিরতে পারেনি, ঢাকায় তাদের আয় নেই বলে বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছে না। বিকাশের দোকানগুলো প্রায় বন্ধ।

রমনা ঘাট। মানে চিলমারী নদীবন্দর। পাশের ডাটিয়াপাড়া। যুগ যুগ ধরে এখানকার জেলেরা আসাম যায় মাছ ধরতে। কদিন আগে কয়েকজন ফিরে এসেছে। সবাই ভূমিহীন। ছোট ছোট খুপরিতে থাকে। এখানে কোয়ারেন্টিন কীভাবে হবে? যারা ঢাকা থেকে ফিরেছে, তাদেরও একই অবস্থা। কিসের কোয়ারেন্টিন, কিসের সোশ্যাল ডিস্যান্সিং।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো ফাঁকা। রোগীরা কোথায় গেল? গাঁয়ে গাঁয়ে এখন প্রসবের কাজে সহযোগিতা করছে কারা?

শহর থেকে ফেরা শ্রমিকেরা কী করবে? গৃহশিল্প নেই, কৃষি নেই, নদী নেই, জঙ্গল নেই। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে কমিউনিস্ট পার্টির এক কমরেডকে মেদিনীপুরের এক চাষিবউ বলেছিল, ‘সত্যি বলতে কি বাবু, কীটা আশা করে আমরা গ্রামে ফিরব? গেলবার খারাপ ফলন হয়নি, তবু নিজেদের গ্রামেই কিছু খেতে পাইনি আমরা।’

এই করোনার কালে মানুষ কিছু খেতে পাবে কি?

নাহিদ হাসান: রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি।
nahidknowledge@gmail.com