Thank you for trying Sticky AMP!!

অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানানোর চেষ্টা

মুক্তিযুদ্ধের সময় কেউ ছিলেন শান্তি কমিটির সদস্যের দেহরক্ষী, কেউ পড়তেন ষষ্ঠ শ্রেণিতে। ৪৬ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁদের নাম তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশের ওই তালিকায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের আত্মীয়স্বজনও আছেন। আর এসব সুপারিশ করেছেন সরকারের একজন মন্ত্রী। ঢাকার দোহারে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় গুরুতর এই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে, স্বজনপ্রীতি করে ও টাকার বিনিময়ে দোহারের ৭২ জন অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর চেষ্টা চলছে।

সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, কৃষক লীগের সহসভাপতি, ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের ভাই, শান্তি কমিটির দেহরক্ষীসহ অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম অনিয়মের মাধ্যমে ঢোকানো হয়েছে যাচাই-বাছাইয়ের সুপারিশের তালিকায়।

যাঁদের নাম অমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রতিবেদনে এসেছে তাঁদের বেশির ভাগই বলেছেন, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম তাঁদের নাম সুপারিশ করেছেন। কারণ, তিনিই ছিলেন যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি।

তবে খাদ্যমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেছেন, উপজেলা কমান্ডার ও কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষর দেখেই তিনি নামের তালিকায় সুপারিশ করেছেন। যদি কিছু হয়ে থাকে সে দায় তাঁর নয়। দোহারের কাউকে তিনি চেনেন না মন্তব্য করে বলেন, উপজেলা কমান্ডার ও কমিটির সদস্যরা যাঁদের নাম সুপারিশ করেছেন, তিনি শুধু ওই তালিকার ওপরে সই করেছেন। অনেক কিছুই হয়েছে তাঁর অনুপস্থিতিতে। ‘আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে অন্য সদস্যরা অর্থ নিয়ে থাকতে পারেন’ বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী।

যদিও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলছেন, মূলত সভাপতির দায়িত্বই হলো নির্ভুলভাবে তালিকা করে সুপারিশ করার। কোনো অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা করার সুপারিশ করা হলে যাঁরা স্বাক্ষর করেন, সবার দায় রয়েছে, তবে বেশি দায় সভাপতির।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনটি সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যরা অনৈতিকভাবে এবং আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছেন। যাচাই-বাছাই কমিটির বৈঠকের পরই বেশির ভাগ সদস্যের নাম ঢোকানো হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সনদ যাচাই-বাছাই করার কথা থাকলেও তা বাছাই কমিটির সদস্যরা করেননি।

খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ছাড়াও সাত সদস্যবিশিষ্ট ওই কমিটিতে ছিলেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রজব আলী মোল্লা, কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের প্রতিনিধি নজরুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি আবুল কালাম, জেলা কমান্ডার ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) প্রতিনিধি আবু সাইদ, জেলা কমান্ডারের প্রতিনিধি শামসুদ্দিন খান। এ ছাড়া স্থানীয় ইউএনও সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে উপজেলা কমিটির সভাপতি যেকোনো সাংসদ হতে পারেন বলে মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার রজব আলীর মোল্লার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে ধরে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রজব আলী তাঁর আপন ভাই সাদিকুর ইসলামের নাম তালিকাভুক্তির সুপারিশ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাদিকুরের বয়স খুব কম ছিল। নকল জন্মসনদ উপস্থাপন করায় তাঁর আবেদন বাতিলও হয়েছিল। এ ছাড়া রজব মোল্লা ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে এলাকার মোশাররফ হোসেনের নাম ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ ছাড়া দোহারের সাতভিটার আওলাদ হোসেন খান, বজলুর রহমান সিকদারসহ নিজের মামাতো, চাচাতো ভাইকে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুপারিশ করেছেন এই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার।

জানতে চাইলে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে রজব আলী প্রথম আলোকে বলেছেন, খাদ্যমন্ত্রীর সুপারিশেই সবার নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম তালিকাভুক্ত করার ব্যাপারেও তিনিই সুপারিশ করেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ইউপি চেয়ারম্যানসহ অনেকের নাম ঢোকাতে তাঁকে বাধ্য করা হয়েছে। যা হয়েছে সভাপতির নির্দেশে ও প্রভাব খাটিয়ে হয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী আওয়ামী লীগ ও জেলা পরিষদের নেতাদের বিষয়ে পক্ষপাতিত্ব করেছেন বলে দাবি করেন রজব আলী।

দোহার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলী আহসান খোকার নাম যাচাই-বাছাইয়ের দিন বাতিল হলেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিজের নাম সুপারিশ করিয়ে নিয়েছেন তিনি। জানতে চাইলে আলী আহসান বলেন, ‘আমি এলাকায় অমুক্তিযোদ্ধা ও আর্থিক অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলেছি তাই আমাকেই অমুক্তিযোদ্ধা বলা হচ্ছে। খাদ্যমন্ত্রী (কমিটির সভাপতি) যাচাই-বাছাই করেই আমাদের নামের সুপারিশ করেছেন।’ কোথায়, কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর না দিয়ে বলেন, ‘দোহারেই করেছি।’

স্থানীয় মুকসুদপুর ইউপির চেয়ারম্যান ও কৃষক লীগের সহসভাপতি আবদুল হান্নান মুক্তিযুদ্ধের সময় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তেন। আবদুল হান্নান বলেন, ‘আমার ওসমানী সনদ আছে। খাদ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’ তবে তিনি দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ষষ্ঠ শ্রেণির নয়, অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, ওসমানী সনদ গ্রহণযোগ্য নয়।

আওয়ামী লীগের থানা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনিও ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের সময় তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতার আত্মীয় হওয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তাঁর নাম সুপারিশ করা হয়েছে। জানতে চাইলে গিয়াসউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেন উপজেলা কমান্ডার রজব আলী ও খাদ্যমন্ত্রী আমার নাম সুপারিশ করেছেন তাঁদের জিজ্ঞেস করেন।’ তাঁরও ওসমানী সনদ আছে বলে দাবি করেন গিয়াসউদ্দিন।

এদিকে মকবুল হোসেন মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় শান্তি কমিটির প্রধান আলাউদ্দিন ব্যাপারীর দেহরক্ষী ছিলেন। তিনি রজব আলী মোল্লার মামাতো ভাই।

অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে দোহার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কে এম আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি শুধু সাচিবিক দায়িত্ব পালন করেছি। যা করার কমিটি করেছে।’

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দোহারের যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যদের অনিয়মের প্রতিবেদনটি পেয়েছি। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়েছে। কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।’