Thank you for trying Sticky AMP!!

আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে ১১ ছাত্র

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ১১ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। দেশের স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এত বেশিসংখ্যক ছাত্রের বিরুদ্ধে জঙ্গি–সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠল।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের তথ্য অনুযায়ী, অভিযুক্তদের চারজন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই), দুজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইপিই) বিভাগের ছাত্র। এ ছাড়া পদার্থবিজ্ঞান, ব্যবসায় প্রশাসন, ইংরেজি ও গণিত বিভাগের ছাত্র রয়েছেন এই তালিকায়। একজন ছাত্রের বিভাগ এখনো চিহ্নিত করা যায়নি।

কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্রদের একজন মোজাম্মেল হোসাইন বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়সহ কয়েকজন ব্লগার হত্যার আসামি। গত বছরের ১৮ নভেম্বর পুলিশ তাঁকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। একই বিভাগের আশফাকুর রহমান ওরফে অয়নকে গত বছরের ২ মে ঢাকা থেকে এবং ৬ আগস্ট গণিতের ইবরাহীম ইবনে মোল্লা ওরফে মোশাররফকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। তা ছাড়া শাবিপ্রবি থেকে ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই আইপিইর ছাত্র আবদুল আজিজ, ২ আগস্ট একই বিভাগের ছাত্র ইফফাত আহমেদ চৌধুরী এবং ২০১৬ সালের ১৮ আগস্ট সিএসইর শিক্ষার্থী সাদমান আবেদীন ওরফে নিলয়কে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। মোজাম্মেল ছাড়া বাকি পাঁচজনই বছরখানেক জেল খাটার পর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

এখন পাঁচ অভিযুক্তকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে। পালিয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কা থেকে পুলিশ ওই ছাত্রদের নাম প্রকাশ করতে চাইছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, শাবিপ্রবিতে আনসারুল্লাহর অনুপ্রবেশ কীভাবে, সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে এদের গ্রেপ্তার জরুরি।

শাবিপ্রবির কোনো কোনো ছাত্রের জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততার বিষয় সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছাত্রসংখ্যা ১০ হাজারের ওপরে এবং অভিযুক্ত ছাত্রের সংখ্যা ১১ জন। তবু আমি বলব পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। কারণ, একজনই ব্যাপক বিধ্বংসী কিছু করে বসতে পারে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা পাঁচজন শিক্ষক বলেছেন, যেসব ছাত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল স্রোতধারার বাইরে ছিলেন বা বদলে গিয়েছিলেন। এসব ছাত্রের কর্মকাণ্ড পরে তাঁরা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার বাইরে আর কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধুলায় যুক্ত ছিলেন না। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৬টি সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী ও ক্রীড়া সংগঠন আছে।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আনসার আল ইসলাম (আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। তারা রিক্রুটমেন্ট করার ক্ষেত্রেও ভালো ছাত্র, ভালো ছেলেদের বেছে নিচ্ছে। মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় দলটি ব্যাপক ভিত্তিতে ঢোকার চেষ্টা করছে কি না—এ সম্পর্কে এখনো যথেষ্ট তথ্য–প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’

শাহজালালে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম

সিলেটের শাবিপ্রবি ও বেসরকারি লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শক্ত অবস্থানের কথা পুলিশ জানতে পারে ২০১৬ সালের দিকে। তবে এখন পর্যন্ত আনসারুল্লাহর প্রধান সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের যোগাযোগটা কীভাবে হলো, সেটা জানা যায়নি। বেশ কিছু ধারণা সামনে রেখে পুলিশি তদন্ত চলছে। এর একটি হলো; জিয়াউল হকের বাড়ি বৃহত্তর সিলেটে, তাঁর লেখাপড়াও সিলেট ক্যাডেট কলেজে। সে হিসেবে সিলেটে তাঁর ভালো যোগাযোগ আছে।

কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের একটি সূত্র জানায়, গত বছরের ৬ মার্চ প্রিজন ভ্যান থেকে মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টার অভিযোগে পুলিশ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। গ্রেপ্তারকৃতদের একজনের নাম জুনায়েদ। জিজ্ঞাসাবাদে জুনায়েদ জানান, তিনি জিয়াউল হকের প্রতিবেশী। পরে জুনায়েদের বাসায়ও তাঁর যাওয়া-আসার প্রমাণ পায় পুলিশ। জুনায়েদের বন্ধু শাবিপ্রবির ছাত্র সায়মনের মাধ্যমে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ে। তবে এই সায়মন কোন বিভাগের ছাত্র, সে সম্পর্কে পুলিশ জানতে পারেনি।

এখন পর্যন্ত পুলিশের ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৪-০৫ শিক্ষাবর্ষে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একজন ছাত্র (সাংগঠনিক নাম আবদুল্লাহ) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর আরেক সহযোগী আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য সংগ্রহের কাজটা করেন সবার অগোচরে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে কথা বলে জানা গেছে, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সন্দেহভাজন ওই ছাত্র সব শেষ এমফিল কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন। তারপর উধাও হয়ে যান। তাঁর পরীক্ষার ফল সম্মান শ্রেণিতে সিজিপিএ ৪–এ ৩ দশমিক ৯৭ এবং স্নাতকোত্তরে ৩ দশমিক ৯২।

ওই বিভাগের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, চতুর্থ বর্ষে এসে ছাত্রটির বেশভূষা বদলে যায়। সে সময়ই ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্রীকে তিনি বিয়ে করেন। ওই ছাত্রটি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য আবেদন করেছিলেন। তাঁর ঠিকানায় কার্ড পাঠানো হলেও তিনি আসেননি।

সিলেটের মধু শহীদ আবাসিক এলাকায় ওই ছাত্রের বাসায় গেলে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, দেড়-দুই মাস ধরে তিনি বাসায় আসেননি। কোথায় আছেন সে সম্পর্কেও তাঁর স্বজনেরা জানেন না। ওই ছাত্রের বাবা বলেন, ‘পারিবারিক ঝামেলার কারণে সে চলে গেছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ওই ছাত্রের কাছ থেকে আইপিই বিভাগের ছাত্র আবদুল আজিজ সংগঠনের দাযিত্ব নেন। সিলেট ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্র আবদুল আজিজ তাঁর বিভাগে প্রথম বা দ্বিতীয় ছিলেন। গত বছরের জুলাইয়ে তিনি গ্রেপ্তার হন।

কারা যুক্ত হচ্ছেন, কেন হচ্ছেন

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অভিযুক্তদের কেউ কেউ উগ্রবাদে দীক্ষিত হয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছেন এবং সমমনাদের খুঁজে নিয়েছেন। ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ইফফাত আহমেদ চৌধুরী দুটি মামলার আসামি। ১১ মাস জেল খেটে সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। ইফফাতের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলে, তিনি (ইফফাত) শহরের যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন, সেটির পরিচালনায় আছে দ্য সিলেট ইসলামিক সোসাইটি। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য ফজলুর রহমান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তাঁর সঙ্গে আবদুল আজিজের বন্ধুত্ব হয়। তাঁরা দুজনেই ইসলামিক শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করতেন।

বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার মোজাম্মেল হোসেন, আশফাকুর রহমান ওরফে অয়ন, সাদমান আবেদীন ওরফে নিলয় ও অপরজন (পলাতক) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের কাছে যে মেসটিতে থাকতেন, সেই মেসের অনেকেই শিবিরের কর্মী ও সমর্থক ছিলেন। তাঁদের ওঠাবসাও ছিল শিবিরের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের পর থেকে মোজাম্মেল হোসেন ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেননি। পরে বাকি তিনজনকে শিবিরের একজন কর্মী অন্য একটি মেসে ওঠান। পাঠানটুলার ওই মেসে গিয়ে জানা যায়, যে তিনটি কক্ষের বাসায় তাঁরা উঠেছিলেন, পরে সেটিরই একটি কক্ষে তিনজন থাকতে শুরু করেন এবং বাসার অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আইপিই বিভাগের একজন ছাত্র সিলেটে হিযবুত তাহ্‌রীরের সমন্বয়ক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ফল ভালো ছিল এবং তাঁর অনেক ভক্ত-অনুরাগীও ছিলেন। তিনি একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, এখন আর তাঁর কোনো হদিস নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগ কী

সিএসই এবং আইপিই বিভাগ থেকে ছাত্রদের গ্রেপ্তারের পর ক্যাম্পাসে নানামুখী আলোচনা শুরু হয়। সিএসই বিভাগের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাঁরা সাবেক ছাত্রদের নিয়মিত ক্যাম্পাসে ডাকছেন। পাস করার পর সামনে ভবিষ্যৎ কত উজ্জ্বল, সে বিষয়ে ছাত্রদের জানানোর চেষ্টা করছেন। আইপিই বিভাগে এখন শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা ছাড়াও সহশিক্ষাকার্যক্রমে যুক্ত করা হচ্ছে।

প্রথম দিকে শিক্ষক ও ছাত্রদের একটি অংশের মধ্যে অভিযুক্তদের সম্পৃক্ততা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের অনেকেই বিষয়টি বিশ্বাস করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক মো. রাশেদ তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রদের গ্রেপ্তার করেছে ঠিকই, কিন্তু পরে আর কিছু জানায় না। ফলে অভিযুক্তরা কীভাবে জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে, সে সম্পর্কে তাঁদের জানার সুযোগ হচ্ছে না। বিষয়গুলো জানলে তাঁদের জন্য ব্যবস্থা নিতে বা সতর্ক হতে সুবিধা হবে।