Thank you for trying Sticky AMP!!

এখনো শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা

>
  • দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন আহত নেতা-কর্মীরা।
  • ১৪ বছর পরও রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না তাঁরা।
  • একটু শান্তি চান তাঁরা।

খোলা ট্রাকের অস্থায়ী মঞ্চের পাশে বসে নেত্রীর বক্তৃতা শুনবেন বলে বেশ আগেই বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন মাহবুবা পারভিন। তাঁর ইচ্ছা অপূর্ণ থাকেনি। সেদিন ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। পরদিন পত্রিকার পাতায় নীল পেড়ে হালকা কমলা রঙের শাড়ি পরা মাহবুবার ছবি দেখে অনেকে বুঝতে পারেননি তিনি জীবিত না মৃত।

গত রোববার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে এসেছিলেন মাহবুবা পারভিন। তাঁর দুই চোখের চারপাশে ফোসকা পড়া। বললেন, গ্রেনেড হামলার সময় এসব ফোসকা পড়েছিল। শুধু ওই ফোসকাতেই ব্যথা অনুভব করেন না তিনি। সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। তাঁর শরীরে ১ হাজার ৮০০ স্প্লিন্টার রয়ে গেছে। ওগুলো চুলকায়, সুইয়ের মতো হুল ফোটায়। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে একবার নিজেই ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে স্প্লিন্টার বের করার চেষ্টা করেছিলেন মাহবুবা! পরে জায়গাটায় ঘা হয়ে যায়। নিয়মিত ওষুধ খেয়ে ব্যথাটা দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। যন্ত্রণা যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন হাসপাতালে ছোটেন।

মাহবুবা রাজনীতিতে যুক্ত হন গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়ার ঠিক আগের বছরে, ২০০৩ সালে। ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা তাঁর জীবন থমকে দেয়। শুধু একটা বিকট শব্দ শোনার কথা মনে আছে তাঁর। আর কিছুই মনে নেই তাঁর।

হামলার পরপরই মাহবুবার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে গিয়েছিল। উদ্ধারকারীরা জানতেন না তিনি জীবিত না মৃত। ভ্যানে করে অন্যদের সঙ্গে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। দুদিন পর তাঁর জ্ঞান ফিরল ঠিকই, তবে স্বামী-সন্তান কাউকেই চিনতে পারলেন না। দেশে চিকিৎসার পর কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি।

এখন কি স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারছেন—এ প্রশ্নে মাহবুবা বলেন, একেক দিন একেক উপসর্গ। জ্বালা-যন্ত্রণা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। তবে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না।

মাহবুবা এখন ঢাকা (উত্তর) স্বেচ্ছাসেবক লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি। এক ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করছেন, অন্যজন স্থপতি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছাকাছি যেতে চেয়েছিলেন, পেরেছেন। মাহবুবা বলেন, ‘আর কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই। নেত্রীর ভালোবাসা পেয়েছি। তিনি সব সময় খোঁজখবর রাখেন। ছেলে দুটো মানুষ হয়েছে। শুধু দেহের একটু শান্তি চাই।’

জীবন থেকে মুক্তি চান রাশিদা আক্তার

গ্রেনেড হামলায় পায়ে ক্ষত হয় রাশিদা আক্তারের। পা যেন কাটতে না হয়, ১৪ বছর ধরে সে চেষ্টাই করে যাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। এবার ক্ষতটা আর নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। কেটে ফেলা হতে পারে পা। তাঁর শরীরেও গ্রেনেডের শত শত স্প্লিন্টার। হাঁটতে পারেন না, বসতে পারেন না, ঘুমাতেও পারেন না। সমস্যা আরও আছে। কানে শুনতে পান না, ফুসফুসে পানি জমেছে, কিডনিতেও সমস্যা। এই জীবন থেকে মুক্তি চান তিনি।

২০০৪ সালে রাশিদা আক্তার ছিলেন ৬৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক। ২১ আগস্ট সমাবেশ চলার সময় বসে ছিলেন আইভি রহমানের কাছেই। গ্রেনেড হামলার পর মরার মতো পড়ে ছিলেন। মারাত্মক আহত রাশিদাকে যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তাঁকে মৃত ভেবে কেউ একজন চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে দিয়েছিলেন। রাশিদাকেও হামলার কয়েক দিনের মাথায় কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁকে রক্ত দিতে হয়েছিল ২০ ব্যাগ। পায়ে হেঁটে সমাবেশস্থলে গিয়েছিলেন, কলকাতা থেকে দেশে ফেরেন হুইলচেয়ারে। ক্রাচে ভর দিয়ে চলতে হয় এখন।

স্বামীর মৃত্যুর পর রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন রাশিদা। যখন-তখন মারা যেতে পারেন—এই শঙ্কা থেকে অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। শরীরের কষ্ট একটুও স্বস্তি দেয় না তাঁকে। তবে এত যন্ত্রণার মধ্যেও তাঁর একমাত্র শান্তি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের খোঁজখবর নেন। একটা ফ্ল্যাট দিয়েছেন, ছেলেমেয়েদের জন্য আর্থিক অনুদান দিয়েছেন।

বিচার চান রেজাউল

২০০৪ সাল, চারদলীয় জোট সরকারের আমল। ধামরাই উপজেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্বে তখন মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। ২১ আগস্ট তিনি ছিলেন ট্রাকের ওপর তৈরি মঞ্চের কাছেই। প্রথম দফা বিস্ফোরণের পরই তিনি আর কিছু শুনতে পাচ্ছিলেন না। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলেন পা ভেঙে গেছে, কিছুক্ষণ পর পেটের ভেতর থেকে কিছু একটা লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখলেন। আওয়ামী লীগের সভাপতির গাড়িকে লক্ষ্য করে ছোড়া গুলির একটি ঢুকে গেল রেজাউলের পেটের ভেতর। রেজাউল তখনো জ্ঞান হারাননি। তিনি দেখছেন আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বহু মানুষের হাত-পা, অনেককেই মৃত মনে হচ্ছে। এর মধ্যে হঠাৎ পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে শুরু করে।

ভ্যানগাড়িতে করে রেজাউলকে কারা যেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে পৌঁছানোর পরই জ্ঞান হারান তিনি। ঢাকায় কিছুদিন চিকিৎসার পর কলকাতায় পাঠানো হয় তাঁকে। এখনো সুস্থ হননি তিনি। গেল ১৪টি বছরে এমন কোনো মাস নেই, যে মাসে তাঁকে হাসপাতালে যেতে হয়নি। হামলার ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চান তিনি।

কাজ চান আকবর

বাঁ হাতের ক্রাচে ভর দিয়ে ধীরে হাঁটেন সম্রাট আকবর। ১৪ বছর ধরে ক্রাচই ভরসা। তাঁর শরীরে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার স্প্লিন্টার রয়ে গেছে। শরীর সুস্থ থাকলে গুলিস্তানের ফুটপাতে ফল বিক্রি করেন। অসুস্থতার কারণে যেদিন ফল বিক্রি করতে পারেন না, সেদিন সংসারের খরচ জোগানো কঠিন হয়ে পড়ে।

মা মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে ২১ আগস্টের জনসভায় গিয়েছিলেন আকবর (তখন ১৮ বছর)। ভয়াবহ সেই দিনের প্রতিটি মুহূর্তের কথা মনে আছে তাঁর। তিনি বলেন, ‘বুক, কান, পা থেকে রক্ত পড়ছিল। চারদিকে মানুষের স্তূপ। আমার বুকের ওপর দিয়ে অনেকে চলে গেছে।’

এখনো যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারেন না আকবর। ১০ শতাংশ জমি ছিল, তা বিক্রি করে চিকিৎসা করিয়েছেন। বিবাহযোগ্য দুটি বোন আর ছোট ভাইয়ের দায়িত্বও তাঁর কাঁধে। আকবর বললেন, প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা তহবিল থেকে তিনি কিছু পাননি। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে মাথা গোঁজার ঠাঁই আর জীবন চালানোর মতো একটি জীবিকা পাবেন—এই আশায় রয়েছেন তিনি।

ছেলে মাহাবুবুরকে নিয়ে গর্ব করেন মা-বাবা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার (তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা) দেহরক্ষী ছিলেন মাহাবুবুর রশিদ। কুষ্টিয়ায় গ্রামের বাড়ি থেকে যাওয়ার আগে মায়ের হাতে ৭০০ টাকা গুঁজে দিয়েছিলেন। দেড় মাস পর বাড়ি ফেরার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু জীবিত অবস্থায় তাঁর আর বাড়ি ফেরা হয়নি। ছেলে হারানোর ব্যথা নিয়ে বেঁচে আছেন মা হাসিনা বেগম।

গত রোববার কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার ফুলবাড়িয়ায় মাহাবুবুর রশিদের বাড়িতে বসে তাঁর মা-বাবার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁরা বলেন, সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর মাহাবুবুর প্রথমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িচালক পরে ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর দায়িত্ব নেন। গ্রেনেড হামলার পর যখন গুলিবর্ষণ হচ্ছিল, তখন নেত্রীকে (শেখ হাসিনা) আড়াল করে রেখেছিল মাহাবুবুর। পিঠে গুলি লাগার পরও শেখ হাসিনাকে গাড়িতে তুলে দিয়েছিল ছেলে।

মাহাবুবুর রশিদের বাবা হারুন অর রশিদ বলেন, ছেলের আত্মত্যাগের কথা সারা বিশ্বের মানুষ জানে। মাহাবুবুরের স্ত্রী-সন্তান আর তাঁদের দায়িত্ব আজও বহন করে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু তাঁর ছেলেটাই নেই।

২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। আহত হন প্রায় ৫০০ জন। তাঁদের অনেকেই আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি।