Thank you for trying Sticky AMP!!

কার্ড কৃষকের, ব্যবসা মধ্যস্বত্বভোগীদের

গ্রামের চায়ের দোকানে আড্ডা। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে চলছে নানা গালগল্প। পুরো গল্পে করোনা পরিস্থিতি প্রাধান্য পেলেও একসময় চলে আসে সরকারি খাদ্যগুদামে কৃষকের খাদ্যশস্য সংগ্রহের প্রসঙ্গটি। গমচাষি রুহুল আমিন বললেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী, গোডাউনে আমি গম দিছি। আবার দেইনি।’ শুনতে শুনতে তাঁদের গল্পের সঙ্গে যুক্ত হই। জানতে চাই, এটা কেমন কথা হলো ভাই? এ কথা শুনে হেসে উঠলেন রুহুল আমিন।

গত শনিবার সদর উপজেলার জগন্নাথপুর এলাকার রুহুল আমিনসহ কয়েকজন গমচাষির সঙ্গে কথা হয়। পরের দুই দিন রবি ও সোমবার রহিমানপুর, জামালপুর এলাকার আরও কয়েকজন গমচাষির সঙ্গে। তাঁদের কথাবার্তায় একটি বিষয় বেরিয়ে আসে, সরকারি গুদামে কার্ডধারী কৃষকদের কাছ থেকে গম কেনা হলেও তাঁদের অনেকে সেই গম বিক্রি করেননি। তাঁদের কার্ড ব্যবহার করে গম বিক্রি করেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।

নিয়ম অনুযায়ী কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি গম কিনবে সরকার। কৃষক যাতে কোনোভাবেই বঞ্চিত না হয়, এ জন্য উপজেলা কৃষি কার্যালয় থেকে কৃষককে কার্ড দেওয়া হয়। কার্ডধারী কৃষকদের মধ্যে লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত কৃষকেরা সরকারি খাদ্যগুদামে নিজের উৎপাদিত ফসল সরবরাহ করতে পারবেন এবং বিক্রির টাকা তাঁদের ব্যাংক হিসাবে জমা হবে।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঠাকুরগাঁও জেলায় ১২ হাজার ৩১০ মেট্রিক টন গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আর সদর উপজেলার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৭২৩ মেট্রিক টন। গত ১৫ এপ্রিল গম সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ৩০ জুন। এবার সরকারিভাবে প্রতি কেজি গমের দর দেওয়া হয়েছে ২৮ টাকা। একজন কৃষক সর্বোচ্চ ছয় টন গম সরবরাহ করতে পারবেন।
তবে কৃষকেরা বলছেন, যে সময়টাতে সরকারি গুদামে গম কেনা শুরু হয়েছে, তখন কৃষকের হাতে গম ছিল না। আগেই বিক্রি করে ফেলেছিলেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তা কম দামে কিনে মজুত করে রেখেছিলেন। এ ছাড়া গুদামে কৃষকের হয়রানির কথা ছড়িয়ে দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকদের কাছ থেকে কৃষি কার্ড হাতিয়ে নিয়েছেন। পরে তাঁরা সরকারি গুদামে কৃষকের কার্ডে গম সরবরাহ করেন।

জানা গেছে, যখন গুদামে গম কেনা শুরু হয়, তখন বাজারে প্রতি মণ গমের দাম ছিল ৯০০ টাকা। সে হিসাবে প্রতি কেজির দাম পড়ে সাড়ে ২২ টাকা। আর সরকারি গুদামের দর ছিল প্রতি কেজি ২৮ টাকা।

গমচাষি রুহুল আমিন জানান, এবার ৩৬ শতক জমি চাষ করে ৯ মণ গম পেয়েছেন। খাওয়ার জন্য কিছু গম রেখে তিনি বাকিটুকু বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন। এরপরও সদর উপজেলা খাদ্যগুদামের গম সরবরাহের যে তালিকা, তাতে তাঁর নাম রয়েছে। সেখানে উল্লেখ রয়েছে তিনি এক টন গম সরবরাহ করেছেন। তাহলে সরকারি গুদামে এই গম কে বিক্রি করল? এমন প্রশ্নের জবাবে রুহুল আমিন জানান, ‘এলাকার রসিদুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ী আমার সঙ্গে দেখা করে বললেন, তিনি আমার নামে গোডাউনে গম দেবেন। আমি বললাম, এতে আমার কোনো অসুবিধা হবে কি না? তিনি বললেন, না। এরপর তিনি আমার কৃষি কার্ড নিয়ে গেলেন। পরে গম ঢোকানোর দিন তিনি আমাকে সরকারি গোডাউনে নিয়ে গিয়ে কাগজপত্রে সই করিয়ে নিলেন। পরে আবার বিল তোলার জন্য তাঁর সঙ্গে সেখানে গেলাম। সেদিন তিনি আমার কাছ থেকে সই করা একটি চেক নিয়ে আমার হাতে ৫০০ টাকা ধরিয়ে দিলেন।’ তিনি বললেন, ‘এখন বুঝলেন তো আমি কী কারণে বলেছিলাম, গোডাউনে আমি গম দিছি। আবার দেইনি।’
গৌরীপুর গ্রামের কৃষক হরিপদ রায় এবার গম চাষ করেছেন এক বিঘা জমিতে। সব গম তিনি বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন। অথচ খাদ্যগুদামে তাঁর নামে সরবরাহ করা হয়েছে এক টন গম। তিনিও জানালেন একই কথা। তাঁর কার্ড নিয়ে রসিদুল গম দিয়েছেন। পরে তাঁকে ৫০০ টাকা দিয়ে তাঁর সই করা ব্যাংকের চেকের পাতা নিয়ে গেছেন।
সরকারি গুদামে গম বিক্রির তালিকায় নিজের নাম থাকার কথা সিঙ্গিয়া গ্রামের জগদীশ রায় জানতেনই না। ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম তাঁকে ডেকে নিয়ে ‘সম্মান’ করবেন বলে বুঝিয়ে তাঁর কাছ থেকে কার্ডটি নিয়ে নেন। পরে তাঁকে এক হাজার টাকা দিয়েছেন।

আরেক ধাপ এগিয়ে রহিমানপুর ইউনিয়নের মোড়লডোবা গ্রামের ওসমান আলীর অভিজ্ঞতা। তিনি এবার গম চাষ না করলেও সরকারি গুদামে গম বিক্রির তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। গম কেনা শুরুর পর ব্যবসায়ী সলেমান আলী তাঁকে ডেকে ‘সম্মানী’ দেওয়ার কথা বলে কৃষি কার্ডটি নিয়ে যান। ওসমান আলীর ছেলে ফারুক হোসেন বলেন, ‘কৃষি কার্ডের বিনিময়ে বাবাকে এক হাজার টাকা দিয়েছেন সলেমান। তা ছাড়া ওই সময়ে আমাদের হাতে গম না থাকায় আমরা গুদামে গমও দিতে পারতাম না।’

জামালপুর এলাকার গমচাষি জাহেরুল ইসলামের কৃষি কার্ড নিয়ে গুদামে এক টন গম দিয়েছেন জাকির হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী। বিনিময়ে তাঁকে কিছু টাকা দিতে চাইলেও জাহেরুল তা নেননি।

এসব অভিযোগের বিষয়ে ব্যবসায়ী রসিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ধান-গমের ব্যবসা করি না। আমি কৃষকের নামে গুদামে কোনো গম দিইনি। কোনো কৃষক অভিযোগ করে থাকলেও সেটা ঠিক নয়।’ আর ব্যবসায়ী সলেমান আলী বলেন, ‘কৃষকেরাই গুদামে গম দিয়েছেন। আমি কৃষকদের নামে গুদামে গম দিয়েছি, এটার কোনো প্রমাণ নেই।’

সদর উপজেলা খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-এলএসডি) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘আমি কৃষি কার্ডের বিপরীতে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে গম কিনেছি। তা ছাড়া গম কেনার পর অ্যাকাউন্ট পে চেকের মাধ্যমে কৃষকের নামে তাঁর ব্যাংক হিসাবে মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। এখানে গম কেনার নিয়মের কোনো হেরফের হয়নি।’
জেলা খাদ্যশস্য ক্রয় কমিটির সদস্যসচিব ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষকেরা যদি সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে ব্যবসায়ীদের কাছে তাঁদের কৃষি কার্ড হস্তান্তর করে, সে ক্ষেত্রে আমাদের কী করার আছে? কৃষকেরা সচেতন না হলে এটা বন্ধ করা যাবে না।’