Thank you for trying Sticky AMP!!

কুষ্টিয়ায় নাজমুলের গুলিবিদ্ধ লাশ নিয়ে নানা প্রশ্ন

নিজ বাড়ির শয়নকক্ষ থেকে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নাজমুল আলমের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার হাটশ-হরিপুর ইউনিয়নের হরিপুর ফারাজীপাড়া গ্রাম। জেলা শহর থেকে এলাকাটির দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার। পিচঢালা গ্রামীণ সড়ক দিয়ে যেতে হয় এই এলাকায়। গড়াই নদের ওপর শেখ রাসেল কুষ্টিয়া-হরিপুর সেতু পার হয়ে প্রধান এই সড়কের পাশেই আলতাব হোসেনের বাড়ি। এই টিনশেডের বাড়ির একটি কক্ষ থেকে গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাতে তাঁর ২৭ বছর বয়সী ছেলে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নাজমুল আলমের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। এ সময় কক্ষটিতে ছিলেন নাজমুলের নববিবাহিত স্ত্রী ঊর্মি খাতুন।

নাজমুল আলমের মৃত্যুর ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড বলে ধারণা পুলিশের। কিন্তু তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের মতে, নাজমুল আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রেও প্রশ্ন থেকে যায়, শটগানটি কোথায়? পুলিশের সূত্রমতে, আত্মহত্যার বিষয়টি ধামাচাপা দিতে পরিবারের কেউ অস্ত্রটি লুকিয়ে রাখতে পারেন। তবে এ ব্যাপারে জোরালো কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক জানান, নাজমুলকে শটগান দিয়ে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে।

তবে ঘটনাটি যখন ঘটেছে, তখন পুরো ফারাজীপাড়া এলাকার মানুষ সাহ্‌রির জন্য সজাগ ছিলেন। মসজিদে মাইকিংও করা হচ্ছিল। এর মধ্যেও নাজমুলের হত্যাকারী এলাকাবাসীর চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে বলে অনেকের ধারণা। কিন্তু হত্যা কিংবা আত্মহত্যা—নাজমুল আলমের মৃত্যু যেভাবেই হোক না কেন, ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী তাঁর ১৯ বছর বয়সী স্ত্রী ঊর্মি খাতুন। রাতে লাশ উদ্ধারের পরপরই ঊর্মি ও নাজমুলের বাবা আলতাব হোসেনকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। কয়েক ঘণ্টা থানায় রাখার পর দুপুরে এই দুজনকে বাড়ি ফেরত পাঠানো হয়। ঊর্মির কাছ থেকে কী তথ্য পাওয়া গেছে এ ব্যাপারে কিছু জানাতে চায়নি পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল কুষ্টিয়ার ওই এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযান ছিল না। নাজমুলের মৃত্যুর ঘটনাটি র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নও (র‍্যাব) ছায়া তদন্ত করছে।

নাজমুল আলমের বন্ধুবান্ধব ও জেলা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা জানান, এলাকায় বেশ দাপটের সঙ্গে চলাফেরা করতেন নাজমুল। সচ্ছল পরিবারের ছেলে হওয়ায় তাঁর নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ কিংবা কোনো মামলা নেই। কোনো দলীয় কোন্দলের সঙ্গেও নাজমুল জড়িত ছিলেন না। তাঁরা কেউ বিশ্বাস করতে পারছেন না যে এমন একটি ছেলেকে কেউ হত্যা করতে পারে। তাঁর আত্মহত্যার বিষয়টিও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের চিন্তারও বাইরে।

কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা বলেন, গত রোববার নাজমুল বিয়ে করেন। তাঁর সঙ্গে দলের কারও কোন্দল বা শত্রুতাও ছিল না। এ অবস্থায় কি কেউ আত্মহত্যা করতে পারেন? তা ছাড়া কেনইবা তাঁকে হত্যা করা হবে।
কুষ্টিয়া ছাত্রলীগের সভাপতি ইয়াসির আরাফাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই মাস আগে নাজমুলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। এর মধ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। কারণ নাজমুল প্রায়ই ঢাকায় থাকতেন।’
পুলিশ, নাজমুলের পরিবার ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, নাজমুল কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে ২০১৫ সালে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর পাস করেন। কোনো চাকরি বা ব্যবসা করতেন না। নাজমুল জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে নাজমুল ছিলেন সবার বড়। নাজমুলের সবচেয়ে ছোট ভাই কয়েক বছর আগে অসুস্থ হয়ে নয় বছর বয়সে মারা যায়। তিন বোনের মধ্যে যমজ বোনের একজন বিয়ে করেছেন। অন্য দুই বোন পড়ালেখা করছেন। বাবা-মা ও বোনদের নিয়ে একই বাড়িতে থাকতেন নাজমুল। গত রোববার পরিবারের সম্মতিতে শহরের কানাবিল এলাকার ঊর্মি খাতুনকে বিয়ে করেন তিনি।
নাজমুল আলমের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গিয়ে দেখা গেছে, গতকাল সকাল ১০টা ৫৭ মিনিটে তিনি প্রোফাইল ছবি পরিবর্তন করেছেন।
নাজমুলের বোন ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রী সালমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, বাবা-মায়ের সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি। মধ্যরাতে প্রচণ্ড শব্দ পান। পরে কক্ষ থেকে বের হয়ে দেখেন, ভাইয়ের দরজা খোলা। মেঝেতে ভাইয়ের লাশ পড়ে আছে। আর ভাবি কাঁদছেন।

নাজমুলের মা নাজমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল ছেলে বউমাকে নিয়ে শহর ও গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন। রাত ১০টায় তাঁরা বাড়ি ফেরেন। খাওয়া শেষে দুজনই শোয়ার ঘরে যান। রাত তিনটার কিছু আগে হঠাৎ গুলির শব্দ পান। ঘর থেকে বের হতে গেলে নাজমুলের বাবা আলতাব হোসেন তাঁকে বাধা দেয়। কয়েক মিনিট পর ছেলের ঘরে গিয়ে দেখতে পান খাটের পাশে মেঝেতে ছেলে পড়ে আছেন। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বাড়ির দুই দিকে দুটি প্রধান ফটক রয়েছে। এর মধ্যে একটি দরজাসহ ছেলের শোয়ার ঘরের দরজা খোলা ছিল।

নাজমুলের স্ত্রী ঊর্মি খাতুন ও বাবা আলতাব হোসেনকে হেফাজতে নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরও ঘটনা সম্পর্কে কোনো তথ্য পুলিশের কাছ থেকে জানা যায়নি। আজ বুধবার বেলা একটার দিকে কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মেহেদী হাসান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার কারণ বোঝা যাচ্ছে না। নাজমুলের স্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য সম্পর্কেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

নাজমুলের বিরুদ্ধে কোনো মামলার আছে কি না, জানতে চাইলে এসপি মেহেদী হাসান বলেন, ‘মামলা ছিল কি না এটি জরুরি বিষয় নয়। তাঁকে যারা মেরেছে, সেটা জানা জরুরি। আমাদের প্রায় সব পুলিশ অফিসার ঘটনার তদন্ত করছেন।’

কুষ্টিয়া জেলার পুলিশের গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, নাজমুল আলম আত্মহত্যা করেছেন বলে তাঁর পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। এ ঘটনার পর অস্ত্র লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

কুষ্টিয়া মডেল থানার এক কর্মকর্তা জানান, নাজমুল আলমের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মারামারির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে দুটি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া তিনি মাদক সেবন করতেন বলে তাঁরা জেনেছেন।

তবে থানা-পুলিশের হেফাজত থেকে বের হয়ে আসার পর প্রথম আলোর সঙ্গে নাজমুলের বাবা আলতাব হোসেনের কথা হয়। তিনি দাবি করেন, দলীয় কোন্দলের কারণে তাঁর ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে কেবল অস্ত্র আইনে একটি মামলা রয়েছে। তা ছাড়া নাজমুল কখনো মাদক সেবন করেননি। পুলিশের উপপরিদর্শক হওয়ার জন্য পড়াশোনা করতেন তাঁর ছেলে।

নাজমুলের স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হলেও স্বামীর মৃত্যু সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা দেননি তিনি। মৃত্যুর ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগে নাজমুল ঘর থেকে বের হয়ে যান বলে জানান তাঁর স্ত্রী ঊর্মি খাতুন। প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাইরে বের হন তাঁর স্বামী। এরপর তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। রাতে নিজের ডান হাতের তর্জনীতে আঘাত পেয়ে জেগে ওঠেন। দেখতে পান, তাঁর তর্জনী দিয়ে রক্ত ঝরছে। পাশে তাকিয়ে দেখেন, নাজমুলের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ মেঝের ওপর পড়ে আছে। এ সময় তাঁদের ঘরের দরজা খোলা ছিল বলে তিনি জানান।

তবে নাজমুল আলমকে মাথায় খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে বলে জানান কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক তাপস কুমার সরকার। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নাজমুল আলমের মাথার ডান দিকে শটগানের একটি গুলির চিহ্ন ছিল। তা ছাড়া তাঁর শরীরে অন্য কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না।