Thank you for trying Sticky AMP!!

খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা কর্মকর্তা, পরে বিসিবিপ্রধানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা

বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসান ও লোকমান হোসেন ভূঁইয়া। ফাইল ছবি

মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ক্লাবের জায়গা ভাড়া দিয়েছিলেন ক্যাসিনো চালানোর জন্য। আর ভাড়া নিয়েছিলেন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। লোকমান বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরও (বিসিবি) পরিচালক।

১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া যখন বিরোধীদলীয় নেতা, তখন তাঁর নিরাপত্তা কর্মকর্তা ছিলেন এই লোকমান। এখন তিনি বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসানের ঘনিষ্ঠ। বিসিবির ফ্যাসিলিটিজ বিভাগেরও প্রধান লোকমান। বিসিবির পরিকল্পনাধীন শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির পাঁচ সদস্যের একজন তিনি। পূর্বাচলে প্রায় ৩৭.৪৭ একর জায়গা নিয়ে নির্মিত হবে ৫০-৬০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার এই স্টেডিয়াম। এর সম্ভাব্য বাজেট ১০০ কোটি টাকা।

বিএনপি সূত্র জানায়, ১৯৯৩ সালে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হন লোকমান। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের কারণে ২০০৮ সালে দল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়।

লোকমান ১৯৯৩-৯৪ সালের দিকে মোহামেডান ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হন বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালুর হাত ধরে। মোহামেডান ক্লাব নিয়েই মোসাদ্দেক আলীর সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়। দ্রুতই ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হয়ে যান লোকমান। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ২০১১ সালে লিমিটেড কোম্পানি হলে তিনি তার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হন। এরপর ২০১৩ সালেও তিনি একই পদে নির্বাচিত হন। এরপর আর নির্বাচন হয়নি। বার্ষিক সাধারণ সভাও হয়নি। অলিখিতভাবে তিনিই ক্লাব চালাচ্ছিলেন। স্পনসর আনা, দল গঠনসহ সব সিদ্ধান্ত তিনিই নিতেন। ক্লাবে একটা পরিচালনা পর্ষদ থাকলেও তা নিষ্ক্রিয়।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লোকমান প্রথম ক্রিকেট বোর্ডে আসেন ২০১২ সালের অক্টোবরে। আগের কমিটির চার বছরের মেয়াদ শেষ হলে সে সময় বিসিবির একটি অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন করে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। ১৩ সদস্যের এই অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির সভাপতি হন বিসিবির বর্তমান সভাপতি নাজমুল হাসান। তিনি তার আগেই সরকার কর্তৃক মনোনীত হয়ে সভাপতির চেয়ারে বসেছিলেন। এই কমিটির একজন সদস্য হিসেবে যুক্ত হন লোকমান। পরে ২০১৩ সালের অক্টোবরে যে ১৯ পরিচালক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, তাঁদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। লোকমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বোর্ড পরিচালক হন ২০১৭ সালের অক্টোবরে বিসিবির সবশেষ নির্বাচনেও।

অথচ, লোকমান যখন ক্রিকেট বোর্ডে পরিচালক হয়ে আসেন, তখন ক্রিকেটের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।

সাত বছর আগেও যাঁর ক্রিকেটের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না, সেই লোকমান কীভাবে বিসিবিতে এলেন, সেটি অবশ্য মনে পড়ছে না বিসিবির পরিচালক সাজ্জাদুল আলমের। তবে তিনি বলেন ‘আগে তাঁকে সরাসরি ক্রিকেটে যুক্ত থাকতে দেখিনি। মাঠে দেখেছি, হয়তো দর্শক হিসেবে এসেছেন। ক্রিকেট সংগঠক হিসেবে তাঁর পরিচয় আমরা জানতাম না। এই বোর্ডের আগের বোর্ড থেকে তাঁকে দেখছি।’

সম্পদ গড়েছেন গত দুই বছরে
র‍্যাব বলছে, ক্যাসিনো থেকে লোকমান গত দুই বছরে ৪১ কোটি টাকা কামিয়েছেন। এই টাকার প্রায় পুরোটাই জমা করেছেন অস্ট্রেলিয়ার এএনজেড ও কমনওয়েলথ ব্যাংকে।

র‍্যাব-২-এর অধিনায়ক আশিক বিল্লাহ গতকাল বৃহস্পতিবার ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, লোকমান মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের জায়গা ভাড়া দিয়ে প্রতিদিন পেতেন ৭০ হাজার (মাসে ২১ লাখ) টাকা। তাঁর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় প্রতিদিন সেখানে ক্যাসিনোর আসর বসত। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেছেন, গত দুই বছরে যে ৪১ কোটি টাকা তিনি উপার্জন করেছেন, তার প্রায় পুরোটাই অস্ট্রেলিয়ায়। ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় থাকায় তিনি প্রায়ই সেখানে যেতেন।

র‍্যাব সদস্যরা বুধবার মধ্যরাতে লোকমানকে রাজধানীর মণিপুরিপাড়ার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করেন। তাঁর বাসা থেকে চার লিটার বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়। গত রাতে তাঁর বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেছে র‍্যাব। ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া ক্যাসিনো-বিরোধী অভিযানে লোকমানসহ বড় মাপের চার ব্যক্তি গ্রেপ্তার হলেন।

লোকমানকে গ্রেপ্তার করা হলেও ক্যাসিনোর জন্য কক্ষ ভাড়া নেওয়া কাউন্সিলর মমিনুলকে খুঁজে পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। র‍্যাব বলছে, অভিযান শুরুর পর লোকমানও গা ঢাকা দিয়েছিলেন। নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে ছিলেন তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে র‍্যাবের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তেজগাঁওয়ে একটি সাততলা ভবন, উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের ৮ নম্বর সড়কে একটি বাড়ি, পূর্বাচলে সাত কাঠা ও বেড়িবাঁধে প্রায় দুই বিঘা জমি আছে লোকমানের। অস্ট্রেলিয়ার ব্যাংক ছাড়াও দেশে কয়েকটি ব্যাংকে টাকা রেখেছেন তিনি। এক কোটি টাকার স্থায়ী আমানত আছে দেশের একটি ব্যাংকে। ট্রাভেল এজেন্সি, কমিউনিকেশন ফার্ম এবং মোবাইল ফোন টাওয়ার ও নির্মাণ খাতের ব্যবসা আছে তাঁর। তবে তিনি মূলত সম্পদ গড়েছেন গত দুই বছরে।

ক্লাবের একটি সূত্র বলছে, দিন দিন জৌলুশ বাড়লেও ফুটবলে ক্লাবটি পিছিয়ে পড়ছিল। ২০০২ সালের পর থেকে ১৭ বছরে ফুটবল লিগে মোহামেডান আর চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। দুই মাস আগে যে ফুটবল লিগ শেষ হলো, তাতে দলটি অষ্টম হয়। টাকার অভাবে ভালো দল গঠন করা যায়নি বলেও অভিযোগ ওঠে। শেষ পর্যন্ত ৫৪ তলা একটি ভবন তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছিল মোহামেডান ক্লাব কর্তৃপক্ষ। সেটি ভাড়া দিয়ে ক্লাবের ব্যয় নির্বাহ করার কথা চলছিল।

বিসিবি বিব্রত, লজ্জিত
বিসিবির পরিচালক লোকমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিসিবি আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও ব্যক্তিগতভাবে অনেকে বিব্রত বোধ করছেন। বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসানের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল আগাগোড়াই। এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য জানতে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। আর বিসিবির মিডিয়া কমিটির প্রধান জালাল ইউনুস বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

বোর্ড পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এসব লোকজন, যাঁরা ক্লাবকে অপব্যবহার করে এ ধরনের অপকর্ম চালিয়ে আসছেন, তাঁদের জন্য আজ ক্রীড়াঙ্গনের প্রকৃত সংগঠকেরা কোণঠাসা। মানুষের কাছে ক্লাব কর্মকর্তাদের এসব কাজের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তাঁরা আরেক দফা বিব্রত হচ্ছেন, অস্বস্তিতে পড়ছেন।

জুয়া ও ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে সরকারের চলমান উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সাজ্জাদুল আলম বলেন, ‘আমি মনে করি, এটা ক্লাবগুলোকে পুনর্গঠনের সুবর্ণ সুযোগ। প্রকৃত সংগঠকদের হাতে ক্লাব এবং সব ক্রীড়া সংগঠনের দায়িত্ব তুলে দিলে ভবিষ্যতে আর এ রকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না।’

বিসিবির আরেক পরিচালক, জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও সাংসদ নাঈমুর রহমান বলেছেন, সন্দেহভাজন হলে তাঁর (লোকমান) বিরুদ্ধে তদন্ত হবে। অপরাধী প্রমাণিত হলে শাস্তিও হবে। সরকারের চলমান শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ রকম অভিযান নিশ্চয়ই আরও চলবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক পরিচালক বলেন, ‘বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খেলার সময় ওনার মতো আরও দু-একজন পরিচালককে দেখি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজনকে টিকিট দিতে, খাতির করতে। এখন বুঝতে পারছি কেন তাঁরা এসব করতেন।’