Thank you for trying Sticky AMP!!

গ্যাস পাওয়া যাবে না জেনেও উত্তোলনে সান্তোসকে অনুমতি

>

• গ্যাস পাওয়া যাবে না জেনেও উত্তোলনে সান্তোসকে অনুমতি
• ১৩ দিনের মাথায় সান্তোস জানায় গ্যাস নেই
• এর আগেই ১২৯ কোটি টাকা উত্তোলন
• আরও ১০১ কোটি টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে সান্তোস

অস্ট্রেলিয়ার তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি সান্তোসকে ২৩০ কোটি টাকা লুটে নেওয়ার অভিনব এক সুযোগ করে দিয়েছে সরকারের জ্বালানি বিভাগ। এর মধ্যে ১২৯ কোটি টাকা নিয়ে গেছে সান্তোস। বাকি ১০১ কোটি টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের সাগরবক্ষের ১৬ নম্বর ব্লকের মগনামা-২-এ গ্যাস পাওয়া যাবে না জেনেও সান্তোসের সঙ্গে যৌথভাবে বাপেক্সকে গ্যাস উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগ। অথচ কথিত কূপ খননের মাত্র ১৩ দিনের মাথায় সান্তোস জানিয়ে দেয়, সেখানে কোনো গ্যাসই নেই। কিন্তু এর আগেই তারা ১২৯ কোটি টাকা ‘লুটে’ নেয়।

সন্তোসের সঙ্গে ১৬ নম্বর ব্লকের উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তির (পিএসসি) মেয়াদ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার পরও ফের মেয়াদ বাড়ায় জ্বালানি বিভাগ। এরপর ২০১৬ সালে বাপেক্সের সঙ্গে যৌথভাবে সান্তোস মগনামা-২ গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের প্রস্তাব দেয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কোনো বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে একবার পিএসসি সম্পন্ন হলে সেই পিএসসি সংশোধন করার সুযোগ নেই। কিন্তু সান্তোসের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি।

জ্বালানি খাতে নজিরবিহীন এ অনিয়মের কারণেই বাপেক্স এখন দেনার দায়ে ডুবতে বসেছে। কেননা সান্তোসকে এই অর্থ দেওয়ার জন্য ২ শতাংশ সুদে ১২ বছর মেয়াদি ঋণ নেয় বাপেক্স। সুদে-আসলে দেনার পরিমাণ এখন ২৬২ কোটি টাকা। আর এসব বেআইনি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগের তৎকালীন সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরী। তিনি তখন বাপেক্সেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি এখন অবসর জীবন যাপন করছেন।

আবার ওই ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রেও করা হয় অনিয়ম। পেট্রোবাংলা, তিতাস গ্যাস, কর্ণফুলী গ্যাস, বাখরাবাদ গ্যাস ও বাপেক্স নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ নিয়মবহির্ভূতভাবে কূপ খননের জন্য বাপেক্সকে ঋণ আকারে দেওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানপ্রধানদেরও এ অনিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে।

এ বিষয়ে বাপেক্সের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও বর্তমানে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের এমডি মো. আতিকুজ্জামান প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে সান্তোসের প্রস্তাবটি বোর্ডে তুলেছিলাম, যাতে প্রস্তাবটি পাস না হয়। আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে মগনামাতে গ্যাস নেই। বোর্ডের চেয়ারম্যান জ্বালানিসচিব, সেখানে অন্যদের কিছু করার নেই।’

তৎকালীন জ্বালানিসচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরী এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা অনেক আগের বিষয়। এ বিষয়ে এখন আমার কিছু মনে পড়ছে না।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কানাডীয় কোম্পানি নাইকো টেংরাটিলার একটি নতুন গ্যাসক্ষেত্রকে পরিত্যক্ত দেখিয়ে ইজারা নিয়েছিল। এরপর সেখানে বিস্ফোরণ ঘটার পর নাইকোকে অনুমোদন দেওয়ার পেছনে দুর্নীতি রয়েছে এমন তথ্য বেরিয়ে আসে। মগনামা-২-এ কোনো গ্যাস নেই জেনেও সেখানে কূপ খননের অনুমোদন দিয়ে নাইকোর মতোই কেলেঙ্কারি ঘটিয়েছে জ্বালানি বিভাগ।

বিষয়টি নিয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন বাংলাদেশ কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ‘বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের অনিয়ম উদ্ঘাটন’ নামে গঠিত একটি কমিশনের খসড়া প্রতিবেদনেও এসব তথ্য রয়েছে। ছয় সদস্যের এই কমিশনের সভাপতি লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ, সদস্য অধ্যাপক এম শামসুল আলম, পদার্থবিদ অধ্যাপক সুশান্ত কুমার দাস, অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম।

কমিশনের খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাইকো চুক্তির মতো সান্তোস চুক্তিতে দুর্নীতি হয়েছে। নাইকো চুক্তিতে সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বিএনপির নেতা এ কে এম মোশাররফ হোসেনের মুখ্য ভূমিকা ছিল। সান্তোস চুক্তিতে সাবেক জ্বালানিসচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরী মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন।

কমিশনের সদস্য, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মগনামা-২-এ গ্যাস পাওয়া যাবে না, এ বিষয়ে বাপেক্স নিশ্চিত ছিল। সে কারণে বাপেক্স কূপ খননে রাজি ছিল না। কিন্তু সান্তোসের সঙ্গে যৌথভাবে বাপেক্সকে কূপ খনন করতে বাধ্য করেছেন নাজিমউদ্দিন চৌধুরী। আর কূপ খননের মাত্র ১৩ দিনের মাথায় সান্তোস জানায়, সেখানে কোনো গ্যাস পাওয়া যায়নি। অভিনব কায়দায় এতগুলো টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এটিকে দুর্নীতি বললে কম বলা হবে। 

আগেই জানা ছিল গ্যাস নেই

জানা যায়, ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে সান্তোসের দেওয়া প্রস্তাবে বলা হয়, ১৬ নম্বর ব্লকের মগনামা-২-এ মোট ১০টি স্তরে সম্ভাব্য গ্যাস রয়েছে ১ হাজার ৬০ দশমিক ৮ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ)। এ পরিমাণ মজুত থেকে উত্তোলনযোগ্য গ্যাস রয়েছে ৭৩৬ দশমিক ২ বিসিএফ গ্যাস। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, এর আগে সান্তোস মগনামা-১ কূপ খনন করে গ্যাস পায়নি। সেই কূপ খননের অর্থও বাপেক্সকে দিতে হবে। এর পরিমাণ ১২৯ কোটি টাকা।

সান্তোসের প্রস্তাবের বিষয়ে সাত সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে বাপেক্স। ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সান্তোস মগনামা-২ গ্যাসের মজুতের যে হিসাব দিয়েছে, তা ঠিক নয়। সেখানে বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য গ্যাস নেই। এর আগে সান্তোস যেখানে কূপ খনন করে গ্যাস পায়নি, সেখান থেকে মাত্র ২ হাজার ২০০ মিটার উত্তর-পশ্চিমে মগনামা-২ কূপের অবস্থান। এখানে গ্যাস থাকার বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত নেই। বাপেক্স যদি সেখানে কূপ খনন করতে যায়, তাহলে সুদে-আসলে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক ক্ষতি হবে ২৬২ কোটি টাকা।

 ‘মগনামা-২-এ বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য গ্যাস নেই’—বাপেক্সের কারিগরি কমিটির দেওয়া এ প্রতিবেদনসহ ২০১৬ সালের ২৪ মার্চ বাপেক্সের পরিচালনা পর্ষদের ৩৭১তম বোর্ড সভায় সান্তোসের প্রস্তাবটি তোলা হয়। কিন্তু কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে বাপেক্সের পর্ষদ সান্তোসের সঙ্গে যৌথভাবে মগনামা-২ কূপ খননের সিদ্ধান্ত নেয়।

বাপেক্সের বোর্ড সভায় নাজিমউদ্দিন চৌধুরী ছাড়াও পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন পেট্রোবাংলার তৎকালীন চেয়ারম্যান ইশতিয়াক আহমেদ, জ্বালানি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার, পেট্রোবাংলার একজন ও দুজন স্বতন্ত্র পরিচালক ছাড়া বাপেক্সের পক্ষে একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন বাপেক্সের এমডি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাপেক্সের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বাপেক্স বোর্ডে সাত সদস্যের মধ্যে দুজন বাদে অন্য পাঁচজন সদস্যই জ্বালানি বিভাগের অনুশাসন মেনে চাকরি করেন। আর জ্বালানি বিভাগের প্রধান সরকারি কর্মকর্তা জ্বালানিসচিব। সে কারণে জ্বালানিসচিবের চাওয়াকে বোর্ডে দ্বিমত করার সুযোগ থাকে না।

জানা যায়, গত বছরের ১৮ জানুয়ারি পেট্রোবাংলার সঙ্গে সান্তোসের গ্যাস ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি সই হয়। চুক্তিতে সান্তোস এর আগে ১৬ নম্বর ব্লকে যে অর্থ ব্যয় করেছিল, সেই ব্যয়ের প্রায় ৫০ শতাংশ (১২৯ কোটি টাকা) বাপেক্সকে পরিশোধ করার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। এর মাত্র ১৩ দিনের মাথায় অর্থাৎ ৩১ জানুয়ারি সান্তোস সরকারকে জানায় মগনামা-২-এ কোনো গ্যাস নেই। এর আগেই সান্তোস ১২৯ কোটি টাকা নিয়ে নেয় বাপেক্সের কাছ থেকে।

জানা যায়, এর আগের সব পিএসসিতে বিদেশি কোম্পানির শতভাগ নিজস্ব খরচে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের শর্ত ছিল। নিয়ম হচ্ছে, গ্যাস পেলে খরচের উশুল হিসেবে গ্যাসের একটি নির্দিষ্ট অংশ তারা নিয়ে বাকি গ্যাস সমানভাবে ভাগ করা হবে। আর গ্যাস না পাওয়া গেলে তা কোম্পানিকে দিতে হয়। অথচ সান্তোসের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি।

অনিয়ম করে সান্তোসকে নানা সুযোগ দিয়ে একদিকে যেমন সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ পানিতে গেছে, তেমনি বাপেক্সের কাঁধে চেপেছে বিশাল এক দেনার বোঝা। এ কারণে জ্বালানি খাতের দেশের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাটি বড় ধরনের বিপাকে পড়ে গেল বলেই মনে করছেন জ্বালানি খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।