Thank you for trying Sticky AMP!!

ঘুষ লেনদেনের মামলায় সাংসদ শহিদের ৪ বছরের জেল  

কাজী শহিদ ইসলাম ওরফে পাপুল

কুয়েতে মানব ও মুদ্রা পাচারের চাঞ্চল্যকর মামলায় আটক বাংলাদেশের (লক্ষ্মীপুর-২ আসন) সংসদ সদস্য মো. শহিদ ইসলাম ওরফে পাপুলের চার বছরের জেল হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার কুয়েতের ফৌজদারি আদালতের বিচারক আব্দুল্লাহ আল ওথমান অবশ্য ঘুষ লেনদেনের মামলায় সাংসদকে বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে ১৯ লাখ কুয়েতি দিনার বা ৫৩ কোটি ১৯ লাখ ৬২ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন। তবে তাঁর বিরুদ্ধে আনা মানব ও মুদ্রা পাচারের মামলার বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

গতকাল বৃহস্পতিবার কুয়েতের আদালত সূত্রে এ পাওয়া গেছে। কুয়েতের একটি সূত্র এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, শহিদ ইসলামের বিরুদ্ধে মানব ও মুদ্রা পাচারের অভিযোগে মামলা হলেও গতকাল তাঁর শাস্তি হয়েছে কুয়েতের বিভিন্ন মহলকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগে।

আজ শুক্রবার সকালে কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সাংসদের বিষয়ে তেলসমৃদ্ধ দেশটি বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কোনো সাংসদ বিদেশের মাটিতে ফৌজদারি অপরাধে শাস্তি পেলেন। শহিদ ইসলাম গত বছরের ৬ জুন রাতে কুয়েতের বাসা থেকে আটক হন। কুয়েতে আটকের সাড়ে সাত মাস আর বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর সাড়ে তিন মাসের মাথায় দণ্ডিত হলেন বাংলাদেশের এই সাংসদ। গতকাল এমন দিন রায়টি এল, যেদিন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২০ সালের দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশিত হলো। এতে খারাপ অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশ ১২তম হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় দুই ধাপ অবনতি।

শহিদ ইসলামকে অনৈতিকভাবে ব্যবসা পরিচালনায় সহযোগিতার অভিযোগে কুয়েতের আদালত সে দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরখাস্ত হওয়া আন্ডার সেক্রেটারি মেজর জেনারেল মাজেন আল জারাহ এবং অন্য দুই মধ্যস্থতাকারী কর্মকর্তা হাসান আল খাদের ও নাওয়াফ আল মুতাইরিকে চার বছর করে জেল দিয়েছেন। শহিদের মতো দণ্ডিত তিন কুয়েতি নাগরিককে ১৯ লাখ দিনার অর্থদণ্ড দিয়েছেন আদালত। তবে ওই মামলার অভিযোগ থেকে আদালত কুয়েতের দুই সাংসদ সাদুন হামাদ আল-ওতাইবি এবং সালাহ খুরশিদকে খালাস দিয়েছেন।

শহিদ ইসলাম কুয়েতে নিবন্ধিত মারাফিয়া কুয়েতিয়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ বলা হয়েছে, কুয়েতে কাজের সুযোগ দেওয়ার নাম করে তিনি বাংলাদেশের কর্মীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। অথচ অধিকাংশই অভিযোগ করেছেন, তাঁদের যে কাজ আর বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেটা হয়নি। শুরুতে এসব অভিযোগ বেমালুম অস্বীকার করেছিলেন তিনি। পরে কুয়েতের গোয়েন্দাদের অব্যাহত জেরা, তথ্যপ্রমাণ আর কুয়েতি সহযোগীদের মুখোমুখি করার পর তিনি অভিযোগ স্বীকার করেন।

একপর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন যে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ আর কাজের চুক্তি আদায়ের জন্য কুয়েতের রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের লাখ লাখ ডলার ঘুষ দিয়েছিলেন।

কুয়েতে বাংলাদেশি সাংসদ শহিদ ইসলামের সাজার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র সাংসদ শহিদ ইসলামের আটক বা সাজা হওয়ার বিষয়ে কুয়েত এখন পর্যন্ত আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। গণমাধ্যম থেকেই তাঁর সম্পর্কে জেনেছি। আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য পাওয়ার পর জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি এবং সংবিধানের আলোকে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ১৭২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সংসদ সদস্য ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার হলে কিংবা কোনো আদালত কর্তৃক কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে বা কোনো নির্বাহী আদেশক্রমে আটক হলে গ্রেপ্তারকারী বা দণ্ডদানকারী বা আটককারী কর্তৃপক্ষ বা জজ বা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে স্পিকারকে জানাবেন।’

এরপর ১৭৬ বিধি অনুযায়ী, স্পিকার যত দ্রুত সম্ভব সংসদ অধিবেশন থাকলে সংসদে তা পাঠ করবেন কিংবা সংসদ অধিবেশন না চললে সদস্যদের অবগতির জন্য তা প্রচার করার নির্দেশ দেবেন।

এদিকে দেশেও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের পৃথক দুই মামলায় সাংসদ শহিদসহ ছয়জনের ৬৭০টি ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার আদালত। এর মধ্যে এই সাংসদ দম্পতির নামেই রয়েছে ৬১৭টি ব্যাংক হিসাব।

মানব পাচার ও অর্থ পাচারের অভিযোগে শহিদসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে গত ২২ ডিসেম্বর মামলা করে সিআইডি। আসামিদের মধ্যে তাঁর মেয়ে, ভাই ও শ্যালিকাও রয়েছে।
এর আগে ১১ নভেম্বর মানব পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে শহিদ ও তাঁর স্ত্রী সেলিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

কে এই শহিদ ইসলাম

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্মীপুরের নিজ এলাকায় রাতারাতি দানবীর হিসেবে আবির্ভূত হন শহিদ ইসলাম।

এলাকার লোকজন জানান, ১৯৮৯ সালে একটি পরিচ্ছন্নতা প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের তত্ত্বাবধায়কের চাকরি নিয়ে কুয়েত যান শহিদ। তখন তিনি ছিলেন অনেকটা নিঃস্ব। ১৯৯০ সালে ইরাকের কুয়েত দখলের কারণে তিনি দেশে ফিরে আসেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার কুয়েতে ফিরে যান তিনি। এরপর লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শত শত মানুষকে চাকরি দেবেন বলে কুয়েতে পাঠানো শুরু করেন শহিদ ইসলাম।

টাকার জোরে সাংসদ

কুয়েতে মানব পাচার ও ভিসা–বাণিজ্যের মাধ্যমের বিপুল টাকার মালিক হন শহিদ ইসলাম। টাকার জোরে নিজে আর স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও সংরক্ষিত আসনের সাংসদ বানান তিনি।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় লক্ষ্মীপুরে অনেকটা প্রকাশ্য আলোচনা ছিল যে ১২ কোটি টাকার বিনিময়ে মহাজোটের প্রার্থী জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ নোমানকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেন শহিদ। ওই নির্বাচনে শহিদ ইসলামের আকস্মিক প্রার্থী হওয়া এবং নির্বাচিত হওয়া ছিল পিলে চমকানোর মতো। যিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও নির্বাচনের আগেই অনেকটা জয় নিশ্চিত করে ফেলেন। এরপর স্ত্রীকেও সংরক্ষিত আসনে সাংসদ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কোটায়। এই দম্পতির সাংসদ হওয়ার প্রক্রিয়ায় অর্ধশত কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে বলে প্রচার আছে।

লক্ষ্মীপুর সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সভাপতি কামাল হোসেন জানান, দেশে যখন সুশাসন থাকে না, তখন অসাধু ব্যবসায়ী ও অসাধু ব্যক্তিরা টাকার জোরে জনপ্রতিনিধি হন। একজন আইনপ্রণেতার বিদেশে সাজা হওয়ার ঘটনাটি দেশের জন্য খুবই লজ্জাজনক। এ সাজার কারণে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।

এক প্রতিক্রিয়ায় রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মামুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাজার বিষয়টি শুনেছি। এটি আমাদের লক্ষ্মীপুর ২ (রায়পুর) আসনের লোকজনের জন্য দুঃখজনক ঘটনা। আর তিনি কুয়েতে এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, এমপি হওয়ার আগে বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না।’
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা; নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ন্যূনতম দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়াসহ কিছু কারণে সংসদ সদস্য পদ বাতিল হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, কোনো ব্যক্তি সাংসদ হওয়ার যোগ্য হওয়া আর যোগ্যতা হারানোর বিষয়ে কোনো অভিযোগ উঠলে নির্বাচন কমিশন তার সুরাহা করে থাকে। আর সংবিধান অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধে কারও দুই বছরের কারাদণ্ড হলে সংসদ সদস্য পদ বাতিলের বিধান রয়েছে। আর সাংসদ শহিদ ইসলামকে এরই মধ্যে কুয়েতের আদালত চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। কাজেই তাঁর ক্ষেত্রে সংবিধানের এ বিধান প্রযোজ্য হতে পারে।